ঢাকা: করোনার থাবায় ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে ব্রিটেনে। এ পর্যন্ত এই ভাইরাসে মারা গেছে ১ হাজার ২২৮ জন আর আক্রান্ত ১৯ হাজার ৫২২ জন । এসব হাজার হাজার রোগীকে দিন-রাত চিকিৎসা দিয়ে সেবা করছে সেখানকার চিকিৎসকরা। আর চিকিৎসা দিতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তিন মুসলিম ডাক্তার। এরা হচ্ছেন সুদানি বংশোদ্ভুত ড. আমজাদ আল হাউরানি ও ড. আদেল আল তায়ার এবং পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত ড. হাবিব জাইদি। তাদের মৃত্যুতে ব্রিটিশ মিডিয়ায় মুসলিমদের নিয়ে যে নেতিবাচক মনোভাব আছে, তা কিছুটা লাঘব হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
৫৫ বছর বয়সী ড. আমজাদ আল হাউরানি প্রথম ব্যক্তি যিনি করোনায় রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে মারা গেলেন। তিনি লেইস্টার রয়েল ইনফার্মারীতে কাজ করার সময় কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন। বারটন কুইন্স হাসপাতালে কান, নাক ও গলা ( ইএনটি) বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। হাসপাতালে করোনার চিকিৎসায় ডাক্তার স্বল্পতায় তিনি রোগীদের কাজ করছিলেন। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি মারা যান। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) ডিরেক্টর প্রফেসর স্টিফেন পইস।
তিনি বলেন, আমজাদের মৃত্যুতে তার পরিবার ও এনএইচএস যে ক্ষতির সম্মুখিন হলো তা পূরণ হবার নয়। এমন দুঃখের সময়ে আমি ও এনএইচএস পরিবার তার পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। বিপদে আমাদের মনোবল ঠিক রেখে করোনা মোকাবেলায় আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
এর আগে বুধবার পশ্চিম লন্ডনের ওয়েস্ট মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান সুদানি বংশোদ্ভুত ড. আদেল এল তায়ার। ৬৩ বছর বয়সী আদেল ২০ মার্চ শুক্রবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ৫ দিন ইনটেন্সিফ কেয়ারে থাকার পর বুধবার তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার আগে তিনি মিডল্যান্ডে একটি হাসপাতালে কাজ করতেন। তবে তার বাসা ছিল লন্ডনে। চার সন্তানের জনক আদেল করোনায় আক্রান্তের পর নির্বিকার হয়ে পড়েন তবে তিনি ছিলেন আশাবাদী সুস্থ হয়ে উঠার।
অঙ্গ প্রতিস্থাপনে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আদেল ১৯৮২ সালে সুদানের ইউনিভার্সিটি অব খার্তুম থেকে গ্রেজুয়েশন করে ব্রিটেন আসেন ১৯৯৬ সালে। ব্রিটেনে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট লন্ডন থেকে পড়াশুনা করে টুটিংয়ের সেন্ট জর্জেস হাসপাতালে ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন হিসেবে কাজ করেন। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি সৌদি আরবের জেদ্দায় কিং ফাহাদ জেনারেল হাসপাতালে কাজ করেন। ২০১১ সালে আদেল তার নিজ দেশ সুদানে গিয়ে একটি ট্রান্সপ্লান্ট প্রজেক্টের কাজ শুরু করেন। একই সময় তিনি খার্তুমে ইবনে সিনা হাসপাতালে কাজ করেন। পরে লন্ডনে এসে তিনি সেন্ট মেরীস হাসপাতালে কাজ শুরু করেন।
এদিকে লন্ডনের অদূরে এসেক্সের সাউথ এন্ড হাসপাতালে মঙ্গলবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান জেনারেল ফিজিসিয়ান ( জিপি) ড. হাবিব জাইদি। ৭৬ বছর বয়সী ড. হাবিব মারা যাওয়ার ২৪ ঘন্টা আগে ইনটেন্সিভ কেয়ারে ছিলেন। তার মেয়ে ড. সারাহ জাইদি বিবিসিকে জানান, কোভিড-১৯ ধরা পড়ার পর ড. হাবিব সপ্তাহ খানিক সেল্ফ আইসোলেশনে ছিলেন। অবস্থা খারাপ হলে তাকে ইনটেন্সিভ কেয়ারে নেয়া হয়।
ড. হাবিব জাইদির স্ত্রী ড. তালাত জাইদি , তিনিও একজন জিপি। তারা উভয়ই ইস্টউড গ্রুপ প্রেকটিসের ম্যানেজিং পার্টনার। তাদের চার সন্তান সবাই মেডিক্যাল পেশায় জড়িত। তাদের ছেলে লন্ডনে রক্ত বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন এবং তাদের এক মেয়ে ট্রেইন সার্জন, একজন ডেন্টিস্ট ও আরেক মেয়ে জিপি। সরকারের নিয়মানুযায়ী পরিবারের অল্প কয়েকজন সদস্য নিয়ে তার জানাযা শেষে লাশ দাফন করা হয়।
ব্রিটেনের সরকার ও জনগণ করোনা মহামারীতে যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে, সেই পরিস্থিতিতে মুসলিম ডাক্তারদের আত্মত্যাগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাদের মৃত্যুতে ব্রিটিশ মিডিয়ায় মুসলিমদের নিয়ে যে নেতিবাচক মনোভাব আছে, তাও কিছুটা লাঘব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের মৃত্যুর পর টুইটারে এক ব্যক্তি উল্লেখ করেন, পরবর্তীতে তোমাদের কেউ মুসলিমদের নিয়ে মন্তব্য করার আগে এই ঘটনা মনে রেখো। ব্লাডি ফরেনার্স বা ব্লাডি মুসলিমস বলার আগে চিন্তা করো, এই মুসলিমরাই করোনার মতো মহা বিপদের সময় ব্রিটিশদের বাচাঁতেই তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিল।