বৃহস্পতিবার রাত ৮টা। ফার্মগেট। দেখে বুঝার উপায় নেই। লোকজন নেই। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। দীর্ঘক্ষণ পরপর দুই একটা ব্যক্তিগত গাড়ি আসে। আমি আর আমার সহকর্মী আলমগীর এক পর্যায়ে একটা রিকশা পেলাম। ৩৫/৪০ বছর বয়স্ক রিকশাওয়ালার চোখে-মুখে উদ্বেগ।
স্বাভাবিক দিনের চেয়ে খুব একটা বেশি ভাড়া চাইলেন না। আমরা রিকশায় চেপে বসতেই বললেন, দ্যাখছেন মনে হয় রাত ২-৩টা বাজে। আসলেই গত কয়েকদিনের ঢাকা অচেনা। বিশেষকরে সর্বশেষ ২ দিন কার্যত লকডাউন। খুব জরুরি কাজ ছাড়া কেউই বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। সবকিছু বন্ধ। যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা আমরা। শুক্রবারের ঢাকার চিত্র ছিল একই। বরং রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি আরো কমেছে।ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করা বহু মানুষ বলছেন, এমন ঢাকা তারা কোনোদিন দেখেননি। একটি ভাইরাস গত কিছুদিনে পুরো পৃথিবীটাই পাল্টে দিয়েছে।
পৃথিবীর সব মেগাসিটি এখন রীতিমতো মৃত। মৃত্যুর মিছিল চলছে। এখানে সেখানে পড়ে আছে লাশ।কত অসহায় মানুষ! মানবজাতির ইতিহাসে এমন সংকট খুব বেশি আসেনি। কোথায় যাচ্ছি আমরা। আমরা কি ফিরতে পারবো আমাদের প্রিয় মুখগুলোর কাছে?মায়ের সাথে কি সন্তানের ফের দেখা হবে। করোনা যে শুধু মৃত্যু আর আক্রান্তের মিছিল তৈরি করেছে তা নয়। করোনা এরইমধ্যে পৃথিবীর অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। বিশেষ করে লকডাউনের মধ্যে গরীব মানুষদের বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে।বেকারত্বের মিছিল লম্বা হচ্ছে। সরকারগুলো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দেশে দেশে গরিব জনগাষ্ঠীর জন্য অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে আরো যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। মানুষ বাঁচাতে হলে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে ধনীদেরও। এটা অস্বীকার করার জো নেই, বহুক্ষেত্রে বাঙালী হুজুগে।সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ঢাকা ছাড়ার দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। এদের মধ্যে হয়তো এমনও অনেকে ছিলেন যাদের ঢাকায় জীবিকা নির্বাহের উপায় নেই সামনের দিনগুলোতে। আবার অনেকে স্রেফ ছুটি কাটাতে বাড়ি গিয়েছেন। যা বহুলাংশে ঝুঁকি তৈরি করেছে। এরপরও কার্যত লকডাউন চলার মধ্যে ঢাকার বাইরে বেশ কিছু মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটেছে। যশোরের মনিরামপুরের একটি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ্য মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।সহযোগী দৈনিক যুগান্তরের এ নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে মাঠে নেমেছে প্রশাসন।
সাধারণ মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। অনেকেই জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন।এমন দুই বৃদ্ধ ভ্যানচালককে কানধরে উঠবস করিয়েছেন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) সাইয়েমা হাসান। শুক্রবার রাতে সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। একজন সরকারি কর্মকর্তার এমন অমানবিক কর্মকাণ্ডে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নেটিজেনরা। এ প্রসঙ্গে শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, ছবিটি আমি দেখেছি। এটি তিনি করতে পারেন না। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা আমাদের কাজ নয়। তাকে শোকজ করব। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে যশোরের মণিরামপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসানের নেতৃত্বে শুক্রবার বিকাল থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে চিনাটোলা বাজারে অভিযানের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে পড়েন প্রথমে দুই বৃদ্ধ। এর মধ্যে একজন বাইসাইকেল চালিয়ে আসছিলেন।
অপরজন রাস্তার পাশে বসে কাঁচা তরকারি বিক্রি করছিলেন। তবে তাদের মুখে মাস্ক ছিল না। এ সময় পুলিশ ওই দুই বৃদ্ধকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করলে সাইয়েমা হাসান শাস্তি হিসেবে তাদের কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। শুধু তাই নয়, এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই তার মোবাইল ফোনে এ চিত্র ধারণ করেন। এ ছাড়া পরবর্তীতে অপর এক ভ্যান চলককে অনুরূপভাবে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এ বিষয়ে জানতে শুক্রবার রাত ১১টার পর কয়েকবার ফোন করলেও রিসিভি করেননি মণিরামপুরের সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) সাইয়েমা হাসান। তবে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালনে ভুল হতে পারে। এজন্য তিনি দুঃখ প্রকাশও করেন।
শেষ কথা: এই দুই পিতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমরা সবাই মিলে মানবিক আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সমাজ আজও তৈরি করতে পারিনি। আগেই বলেছি, এ বড় অসহায় সময়। এ সময়ে সবার আগে মারা যায় প্রেম, ভালোবাসা। এমনকি কোনো কোনো এলাকায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা আর দাফনেও বাধা এসেছে। কী অচিন্তনীয় দৃশ্য। আসুন ঘৃণা নয়, আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়াই। ভালোবাসাই পারে মানুষকে জয়ী করতে।