ঢাকা: করোনা ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী। হু হু করে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১১ হাজার আর আক্রান্ত হয়েছে পৌনে তিন লাখ মানুষ। অদৃশ্য এই শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছে পুরো বিশ্ব। উন্নত দেশগুলো এটিকে যুদ্ধাবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছে আর জাতিসংঘ একে মহামারি আখ্যা দিয়ে বলছে ভয়াবহ মন্দা আসন্ন, ছাড়িয়ে যাবে অতীতের সব রেকর্ড।
পাশের দেশ ভারতে করোনা ভাইরাসের হুমকি নিয়ে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক শীর্ষ একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ, ডিনামিক্স, ইকোনমিক্স এন্ড পলিসি’র পরিচালক বিবিসি-কে বলেছেন ভারত হবে করোনা ভাইরাস মহামারির পরবর্তী ‘হটস্পট’ এবং দেশটিকে অতি জরুরি ভিত্তিতে ‘করোনা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সুনামির’ প্রস্তুত হতে হবে। তিনি যুক্ত করেন, ভারতেই কমপক্ষে ৩০ কোটি লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ২০শে মার্চের খবর পর্যন্ত মক্কা-মদিনাসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ মসজিদে নামাজ পড়া সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। পৃথিবীর সব উন্নত দেশ এই সংকট মোকাবিলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে।
ইউরোপের অবস্থা নতুন করে বলার কিছু নেই।
চার্চগুলোতে জমা পড়ছে কফিন, দাফনের অপেক্ষায় সারিবদ্ধভাবে সাজানো। যারা বাড়িতে মারা গেছেন তাদের লাশ বাড়িতেই রাখা হয়েছে সিলগালা করে, সেখানেই পড়ে থাকছে কয়েক দিন। ইরান তার মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করছে বলে অভিযোগের মুখে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে ইরান মৃতদের দাফনের জন্য গণকবর খুঁড়ছে।
প্রথমে যখন চীনে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় তখন চীনও বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া দূরেই থাকুক, গোপন করার চেষ্টা করে। এমনকি যে ডাক্তার প্রথম এই ভাইরাসটির কথা জানান দেন তাকেও সরকারের ভর্ৎসনার স্বীকার হতে হয়েছে এবং এই ব্যাপারে তাকে নীরব থাকার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়। দুঃখজনকভাবে পরবর্তীতে সে ডাক্তারও করোনাতেই মারা যান। শুরুতে গোপন করার একই অভিযোগ ইতালি এবং ইরানের বিরুদ্ধেও ছিল এবং সেটার ভয়ঙ্কর মাশুল তারা এখন দিচ্ছে। ভাইরাসটির সংক্রমণ যে কতটা ভয়াবহ একটি ক্ষুদ্র পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়। ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, যেখানে প্রথম ১ লাখ মানুষ সংক্রমিত হয়েছিল তিন মাসে সেখানে পরবর্তী এক লাখ মানুষের সংক্রমিত হতে সময় লেগেছে মাত্র ১২ দিন। অর্থাৎ সংখ্যাটি বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।
আমি ডাক্তার না। এর চিকিৎসা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু একজন সচেতন মানুষ হিসেবে বিষয়টির ভয়াবহতা আমার না বোঝারও কিছু নেই। কয়েকটি নগর রাষ্ট্র বাদ দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমি আতঙ্কিত। বাংলাদেশে যখন প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের ঘোষণা আসে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য এটুকুই যথেষ্ট হওয়ার কথা ছিল। অথচ আমরা দেখলাম লোকে দল বেঁধে পরিবার পরিজন নিয়ে চলে গেল পতেঙ্গা কক্সবাজারসহ দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে, যেন এটা একটা উৎসব। সবার চোখে-মুখে ঈদের খুশি। আমি যাদের কথা বলছি তাদের বেশিরভাগই সমাজের শিক্ষিত-সচেতন অংশের বাইরে নন। এক পর্যায়ে পুলিশ কমিশনার বাধ্য হন চট্টগ্রামের পর্যটন কেন্দ্র থেকে দর্শনার্থীদের সরিয়ে দিতে।
খবরে এসেছে ২১শে জানুয়ারি থেকে ১৭ই মার্চ পর্যন্ত ৫৫ দিনে বিশ্বে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছে ৬ লাখ ২৪ হাজার ৭৪৩ জন। আর হোম কোয়ারেন্টিনে আছে ২৫১৮ জন। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আছে মাত্র ৪৩ জন। আর আইসোলেশনে ১৯ জন। বাকিরা মিশে গেছে জনতার কাতারে এবং তাদের আপডেট আমাদের সবার অজানা। যেখানে একজন মানুষ থেকে অসুখটি ছড়াতে পারে অগণিত মানুষের মধ্যে সেখানে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে আর নতুন কিছু যুক্ত করার প্রয়োজন আছে কি?
মূলধারা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি একেকজন চাল-ডাল-তেল-লবণ-চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুদামজাত করে বাসায় প্রায় বাজার বানিয়ে ফেলেছেন। এই সুযোগে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা মৌসুম বুঝে একেকটি জিনিসের দাম বাড়িয়েছে কয়েকগুন। একবার চিন্তা করেছেন সমাজের নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের কথা, যাদের একদিনের বাজার করতে হিসাব করতে হয় কয়েকবার। উন্নত দেশগুলোতে যেখানে সরকার দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, এমনকি বেতন-ভাতা পর্যন্ত। সেখানে আমাদের দেশে সরকারের কাছে এমন প্রত্যাশা পাগলামির চেয়ে বেশি কিছু না। যে দেশে বন্দরগুলোতে রোগ ধরা পড়ার পরেও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না, হাজার বার ঘোষণা হয় কিন্তু হাসপাতালগুলোতে ন্যূনতম কোনো প্রস্তুতি রাখা হয় না, সরকার ব্যস্ত থাকে আতশবাজি আর নির্বাচন ও ভোট উৎসব নিয়ে সেখানে আপনাকে বুঝতে হবে যে আপনার এক মুহূর্তের অসতর্কতা বা উদাসীনতা মৃত্যুর মুখে ফেলবে আপনাকে এবং আপনার গোটা পরিবারকে।
হোম কোয়ারেন্টিনের সঠিক নিয়ম মেনে অল্প যে ক’জন আছেন তারাও আছেন বিপাকে। তাদের দেখতে দলে দলে লোক ভিড় করছেÑ বাসার আশেপাশে যেন নতুন এক চিড়িয়াখানা স্থাপিত হয়েছে। এই লেভেলের সচেতনতা নিয়ে যে দেশের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ বাস করে, সেখানে বিশৃঙ্খল জাতিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বহু আগেই সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন ছিল। উৎসবে ব্যস্ত সরকার মুহূর্তের জন্যও বিষয়টি ভেবেছে বলে মনে হয় না। বিশ্বের তাবৎ মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর সরকারদের কথা সরিয়েই রাখি, ঘরের পাশে ভারত, ভুটান, শ্রীলঙ্কা যে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে সেখানে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসকদের পর্যন্ত নিরাপত্তার ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
তাই আপনি যখন বিদেশ থেকে ফিরে কোয়ারেন্টিনে না থেকে জনসমাগমের স্থানে ঘুরে বেড়ান, বিয়ে করেন, বৌভাতের আয়োজন করেন, আপনি যখন আতশবাজি উৎসব দেখতে জমায়েত হন, কিংবা জমায়েত হন কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থা ‘চিড়িয়া’ দেখতে, যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগে ঘুরে বেড়ান নানা জায়গায়, প্রতিদিন বিকালে এখনো চা দোকানের আড্ডায় আপনি বন্ধুদের সঙ্গে গা ঘেঁষে বসে আড্ডাবাজি করেন, তখন অন্য অনেকের তো বটেই নিজের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে দেয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন। বুঝতে পারছেন, কি বলছি আমি?
আপনি তরুণ, তাই ভাবছেন এই রোগে মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই আপনার। আপনি ভুল ভাবছেন, গতকালই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে আপনার সম্ভাবনা বৃদ্ধদের চাইতে কম, কিন্তু এই রোগে আপনিও মারা যেতে পারেন। আর যদি মারা না-ও যান, আপনি তো আপনার বাবা-মাকে এই রোগ ছড়িয়ে দিতে পারেন না এবং তাদের তো মারা যাবার ঝুঁকি অনেক বেশি। ভাবুন তো উন্নত দেশগুলোর সর্বাধুনিক হাসপাতালে অনেক আইসিইউ ফ্যাসিলিটি থাকার পরও যেখানে এতো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মারা যাচ্ছেন, সেখানে এই দেশে হাতেগোনা কিছু সরকারি আইসিইউ-তে কি জায়গা পাবে আপনার বাবা-মা? সরকারিতে না পেলে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ-তে প্রতিদিনের বিল ৬০-৭০ হাজার টাকা দিতে পারবেন? তাহলে তরুণ, কেন আপনি আপনার বাবা-মা এর মৃত্যুর কারণ হতে যাচ্ছেন? সেটা হলে পারবেন নিজেকে ক্ষমা করতে?
করোনা এড়ানোর জন্য কী কী করতে হবে আর কী করা যাবে না, তা ইতিমধ্যেই আপনারা সবাই জানেন। সুতরাং নিজের কথা চিন্তা করে হোক কিংবা পরিবার, বাঁচতে যদি চান এই মুহূর্ত থেকে সকল সাবধানতা মানতে হবে। এখানে একটি মুহূর্ত সমান অসংখ্য জীবন।