ঢাকা: ইসলামী বিশ্বাস মতে, লাইলাতুল মিরাজ বা মিরাজের রাত শবে মিরাজ নামে অভিহিত। এ রাতে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: অলৌকিক উপায়ে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করে মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাৎ করেন। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ৬৩ বছর জীবনের অসংখ্য ও অগণিত বিশেষত্বের মধ্যে একটি গৌরবমণ্ডিত, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও চমকপ্রদ ঘটনা হলো মিরাজ বা ঊর্ধ্বজগৎ ভ্রমণ। মহানবী সা:-এর মিরাজ মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়। ‘মিরাজ’ আরবি শব্দ। মূল শব্দ ‘উরুজ’ অর্থাৎ উত্থান; সাধারণ অর্থে, ঊর্ধ্বারোহণ বা সিঁড়ি বা সোপান। অন্য অর্থ, ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ বা মহামিলন। ইসলামী পরিভাষায় এটি অতুলনীয় অলৌকিক ঘটনার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যার সাথে রয়েছে ঈমানের গভীরতম সম্পর্ক। এটি বিজ্ঞানের এবং মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়। মিরাজের বৈজ্ঞানিক যুক্তি খুঁজতে যাওয়া অবান্তর চিন্তা ও অপ্রয়োজনীয় মাত্র। সীমিত জনগণের যুক্তির ক্ষমতা যেখানে শেষ, ঈমানের যাত্রা সেখান থেকে শুরু। মিরাজ মূলত একটি মোজেজা। মিরাজ বিশ্বের ইতিহাসে শুধু সাধারণ ঘটনা নয়, বরং মানবতার মুক্তির দূত ও নবীকুল শিরোমনি হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনের একটি অত্যাশ্চর্য ও বিস্ময়কর অধ্যায়। ইসলামের ইতিহাসে পবিত্র শবে মিরাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ৫০ বছর বয়সে অর্থাৎ নবুওয়াতের দশম বর্ষে, হিজরতের দেড় বছর আগে ৬২০ খ্রিষ্টাব্দের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে লাইলাতুল মিরাজের মহিমান্বিত ও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল।
মিরাজের প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ মক্কা নগরের পবিত্র কাবা শরিফে বা মসজিদুল হারামের হাতিম থেকে পবিত্র জেরুসালেমের মসজিদুল আকসা অবধি বোরাকে পরিভ্রমণ ও অবতরণ করা পর্যন্ত ইহলোক ভ্রমণকে ‘ইসরা’ বলা হয়। এখান থেকেই নূরের চলন্ত সিঁড়িযোগে মহাকাশ তথা ঊর্ধ্বলোকে সফরকে মিরাজ বলা হয়ে থাকে। সামগ্রিকভাবে এ নভোমণ্ডল পরিভ্রমণ ‘শবে মিরাজ’ নামে পরিচিত। পৃথিবীর ইতিহাস এহেন যুগান্তকারী ঘটনা নজিরবিহীন। পবিত্র কুরআনে একাধিক সূরা ও হাদিস শরিফে লাইলাতুল মিরাজের বর্ণনা রয়েছে। সে রাতে মহানবী সা:কে হাতিমের কাছে নিয়ে আসা হয়। এরপর জমজমের কাছে নিয়ে তাকে সিনা চাক বা বক্ষ বিদারণ করা হয়। তারপর পানি দিয়ে ধৌত এবং ঈমান ও হিকমত দ্বারা পরিপূর্ণ ও শক্তিশালী করে পুনরায় যথাস্থানে সংস্থাপন করা হয় হৃৎপিণ্ড। এরপর রাসূল সা: অজু করে হাতিমের কাছে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। পরে বিদ্যুতের চেয়েও দ্রুতগতিসম্পন্ন একটি বেহেশতি যান ‘বোরাকে’ নবীজীকে আরোহণ করানোর সাথে সাথেই তা দ্রুতগতিতে ছুটতে থাকে। এক হাজার মাইল দূরত্বে প্রথমে মদিনা মুনাওয়ারা, পরে মূসা আ:-এর স্মৃতিবিজড়িত সিনাই পর্বত, তারপর হজরত ঈসা আ:-এর জন্মস্থান ‘বায়তে লাহম’ হয়ে চোখের পলকে জেরুসালেমের মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে পৌঁছালেন।
এখানে সব নবী-রাসূল নবীজীকে প্রাণঢালা স্বাগত এবং অপূর্ব সংবর্ধনা জানান। হজরত জিবরাইল আ: আজান ও ইকামত দেন। নবী-রাসূলদের মুকুট তুল্য মুহাম্মদ সা: সেখানে আম্বিয়া কেরামের সাথে দুই রাকাত নামাজের জামাতে ইমামতি করেন। তিনি হলেন ইমামুল মুরসালিন অর্থাৎ সব নবী-রাসূলের ইমাম। নামাজের পর জিবরাইল আ: উপস্থিত সবার সাথে রাসূলুল্লাহ সা:-এর আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দিলেন। নৈশভ্রমণের প্রথমাংশ সমাপ্ত হওয়ার পর নবী করিম সা: পুনরায় বোরাকে আরোহণ করার পর তা দ্রুতগতিতে ঊর্ধ্বলোকে যাত্রা শুরু করে।
প্রথম আসমানে হজরত আদম আ:, দ্বিতীয় আসমানে হজরত ঈসা আ: ও হজরত ইয়াহিয়া আ:, তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ আ:, চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস আ:, পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন আ:, ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা আ: এবং সপ্তম আসমানে হজরত ইব্রাহিম আ:-এর সাথে মহানবী সা:-এর সাক্ষাৎ ঘটে এবং পরস্পর শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করেন। সপ্তম আসমানে অবস্থিত আসমানি কাবাগৃহ বায়তুল মামুরে তিনি অসংখ্য ফেরেশতাকে নামাজ আদায় করতে দেখেন। এরপর, তিনি জিবরাইল আ:-এর সাথে বেহেশত ও দোজখ পরিদর্শন করেছিলেন। এভাবে সপ্তম আসমান থেকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এসে সফরসঙ্গী হজরত জিব্রাইল আ:, হজরত মিকাইল আ: ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর ঐশী বাহন বোরাকের গতি স্থির হয়ে যায়। জিব্রাইল আ: এখানে থমকে দাঁড়িয়ে মহানবী সা:কে বললেন, সামনে অগ্রসর হওয়ার আর কোনো ক্ষমতা আমার নেই। এখানেই রাসূলুল্লাহ সা: ফেরেশতা জিবরাইল আ:কে তার স্বরূপে দেখতে পান। নবীজীর বাহনের এখানে পরিবর্তন ঘটে। রাসূলুল্লাহ সা: ‘রফরফ’ নামক বিশেষ স্বর্গীয় বাহনে আরোহণ করে রাব্বুল আলামিনের অসীম কুদরতে কল্পনাতীত দ্রুতবেগে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পেরিয়ে আরশে মুয়াল্লার (আরশে আজিম) সন্নিকটে পৌঁছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে হাজির হলেন। নূরের সৌরভের মহাসমারোহে তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন। এখানেই আল্লাহ তায়ালার সাথে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর দিদার ও কথোপকথন হয়েছে। তিনিই একমাত্র মহামানব, যিনি সশরীরে ও চর্মচোখে পরম করুণাময় আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা: ঐশী করুণা ও শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ পুরস্কার হিসেবে আল্লাহর বান্দাদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে ওই রাত ও ঊষার সন্ধিক্ষণে মক্কায় নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। বিস্ময়ের ব্যাপার, তিনি ফিরে এসে দেখতে পান, তার অজুর পানি তখনো গড়াচ্ছে এবং তার বিছানা তখনো উষ্ণই ছিল।
উল্লেখ্য, উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হলেও শবে মিরাজে পথিমধ্যে হজরত মুসা আ:-এর পরামর্শে আল্লাহর দরবারে সুপারিশক্রমে মোট ১০ দফায় তা কমতে কমতে পাঁচ ওয়াক্তে এসে দাঁড়ায়। তবে পাঁচ ওয়াক্ত ৫০ ওয়াক্ত নামাজের সমান সওয়াবের অধিকারী হিসেবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়। নামাজ যেহেতু আল্লাহর প্রতি বান্দার অপরিহার্য আনুগত্যের বাস্তব রূপ, সেহেতু নামাজ আল্লাহর সাথে মিরাজের সমতুল্য। এই ইবাদতের মাধ্যমেই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা যায় এবং মুমিনরা আত্মিকভাবে তাঁর দিদার পেয়ে থাকেন। বস্তুত মহানবী সা:-এর মিরাজ পরম বিস্ময় সৃষ্টিকারী মোজেজা। রাসূলুল্লাহ সা:-এর মিরাজের অনুপম শিক্ষা বিভিন্ন দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছে। মহাবিশ্বে পরিভ্রমণের মাধ্যমে সৃষ্টি রহস্য উদঘাটনের পরম সৌভাগ্যে রাসূলুল্লাহ সা:কে ভূষিত করে মানবমর্যাদার শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহ তায়ালা মিরাজের মাধ্যমে দিয়েছেন। এ রাতে বায়তুল মুকাদ্দাসে মহানবী সা:-এর ইমামতিতে হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে সব নবী-রাসূল আ: নামাজ আদায় করার মাধ্যমে নবীজীর সর্বশ্রেষ্ঠত্ব ও তার নৈতিক, আদর্শিক, সামাজিক, তথা সার্বিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার অনুসরণীয় বিশ্বজনীন স্বরূপই প্রমাণিত হয়েছিল।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি কলেজ, কলারোয়া, সাতক্ষীরা