ড. কামাল হোসেন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব কিছুর ঊর্ধ্বে। জাতির পিতা শুধু নামে না বাস্তবে। উনি সারা জীবন আমাদেরকে নিয়ে রাজনীতি করেছেন। বাঙালির যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল যার ফলে বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারলাম এটাতে তার অবদান অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছেন আপসহীনভাবে। কতবার উনাকে জেলে নিয়েছে, হত্যা করার চেষ্টা করেছে কিন্তু উনি পিছপা হননি। আর এটা উনার বিশেষ গুণ ছিল। হাজার কোটি টাকা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কেনার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারতো না।
উনার সেরকম কোনো দুর্বলতাও ছিল না। বঙ্গবন্ধু নীতি আদর্শের ব্যাপারে আপসহীন ছিলেন। এটা সবাই জানতো। তিনি এক চুলও নড়েননি। ছয় দফা তো ছয় দফাই থাকবে। সাড়ে পাঁচ দফা হবে না। উনি সংগঠনে বিশ্বাস করতেন। সব সময় আমাদের বলতেন মানুষের মাঝে যাও, সংগঠন করো। রাজনীতির মূল হচ্ছে সংগঠন। এটা অনেকেই বুঝতেন না, অনেকেই মনে করতেন বঙ্গবন্ধু আঙ্গুল নাড়িয়ে একটা কথা বলতেন আর সেটাই হয়ে যেত । এর পেছনে যে তিনি সব মানুষের কাছে গিয়ে আস্থা অর্জন করেছেন সেই কারণেই তার আঙ্গুল নাড়ানোটা অর্থবহ হতো। বাঙালির ঐক্য এই বিষয়টি থেকে কোনো দিন নড়েননি তিনি। বাঙালিরা বিভক্ত হোক, আমাদের মধ্যে দলাদলি হোক এটা তিনি কখনো চাননি। আপ্রাণ উনি চেষ্টা করে গেছেন ঐক্যটা বজায় রাখতে। তরুণদের ওপর উনার যে আস্থা ছিল সেটা তিনি রেখে গেছেন। ছাত্রদেরকে সব সময় মনে করতেন যে, ওদেরকে যদি নীতির দিক দিয়ে সঠিক পথে রাখা যায় তখন সেই রাজনীতি একটা নীতিভিত্তিক রাজনীতি হবে। বর্তমান ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে কামাল হোসেন বলেন, এটা এখন সব চেয়ে দুঃখজনক বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে উনি যা বলেছেন তার উল্টো রাজনীতি করা হচ্ছে। বিভক্তির রাজনীতি। ভাগ করার রাজনীতি। টাকা পয়সা দিয়ে মানুষকে পক্ষে টানা এটা অকল্পনীয় ছিল। আগে ছাত্র রাজনীতি কেউ টাকার জন্য করতো না। সমাজের অবক্ষয় হয়েছে। সমাজের অবক্ষয় নিয়ে আমাদের সকলের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। এখন টাকা, টাকা আর টাকা। হাজার হাজার কোটি টাকা। ছাত্র রাজনীতি করে দেশে, বিদেশে বাড়ি থাকবে এটা অকল্পনীয় ছিল। এখন তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির নামে অসৎ ব্যবসা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন এটাতো হতে দিতেন না। তিনি শক্ত অবস্থান নিতেন এবং এটা হতে দিতেন না। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে উনার নামে এসব করা হচ্ছে। এটাতো প্রশ্নই আসতো না উনার নাম ভাঙিয়ে উল্টো জিনিসগুলো করা। আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিটিং করেছি একটা ছোট কামরায় বসে। অনেক জায়গায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পায়ে হেঁটে গিয়েছি। আমাদের গাড়ি ছিল না। এখন দেখা যায় ছাত্র নেতা, পাতি নেতা এদেরও গাড়ি আছে বাড়ি আছে। একটা না কয়েকটা করে আছে। তখন এটা কল্পনাও করা যেত না। আমরা যখন পার্টিতে জয়েন করলাম বঙ্গবন্ধু বললেন তোমরা ঢাকায় বসে থেকো না। জেলায় জেলায় যাও, মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করো। ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলো। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি যারা করেছে বুঝে করেছে। রাজনীতি কেন করছে? এজন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। ছয় দফা কী এবং কেন? বঙ্গবন্ধুর এক কথা ছয় দফা মানে ছয় দফা সাড়ে পাঁচ দফা নয়। পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিল আপনি পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে এত চিন্তিত কেন? আপনি পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি তো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করি না। আমি রাজনীতি করি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এটা আমি সামনা সামনি দেখেছি কীভাবে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেটা নিয়ে আমরা সব সময় গর্ব করতাম, ‘মানুষের মাথা কেনা যায় না গরু ছাগলের মাথা কেনা যায়’। এটা বঙ্গবন্ধুর কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু আমাদের সব সময় এ কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতেন মানুষের মাথা হাজার কোটি টাকা দিয়েও কেনা যায় না। বর্তমানে সবচেয়ে নেতিবাচক জিনিস ঘটেছে সেটা হচ্ছে টাকা পয়সা ছড়িয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ, তরুণদের চরিত্র নষ্ট করে দেয়া লোভী বানিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। গরু-ছাগলের মাথা কেনা যায় মানুষের মাথা কেনা যায় না- বঙ্গবন্ধুর একথাটি থেকে এরা কত দূরে যে সরে এসেছে। এখনকার আওয়ামী লীগ তো বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নয়। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ছিলাম তারাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করি। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি তো টাকা পয়সা সম্পত্তি করার রাজনীতি ছিল না। উনি কিছু করেও যাননি, রেখেও যাননি। এবং কিছু করার চিন্তাও করেননি। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হলেন। সকল মানুষের ভালোবাসা অর্জন করলেন। তারপরও উনি ব্যাংকে কিছু রেখে যাননি। উনি কত সৎ ছিলেন। তার রাজনীতি ছিল মানুষের সেবা করা। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সরকারের কুকর্মের ব্যাপারে জনগণকে ঐক্যবন্ধ করে প্রতিবাদ করা। সেই রাজনীতি তো আমরা করে যাচ্ছি। এখন ওরা তো নামে আওয়ামী লীগ কাজে তো মুসলিম লীগ যা করতো ওরা তাই করছে। এমনকি ধর্মের অপব্যাখ্যা তারা করছে। এটা তো সবচেয়ে পরিহাস এবং দুঃখের কথা মুসলিম লীগ যা করতো সাম্প্রদায়িকতা, টাকা দিয়ে সরকারের পক্ষে লাঠিয়াল তৈরি করা এখনকার তথাকথিত আওয়ামী লীগের অনেকে তাই করছে।
আরেকটি বিষয় হলো জয় বাংলা স্লোগান। জয় বাংলা আর বঙ্গবন্ধু এক সূত্রে গাঁথা। জয় বাংলা স্লোগানটি একটি রণধ্বনি। এটা অন্তর থেকে মানুষের মুখে আসে। বাধ্য করতে হয় না। এগুলো তো আইন করে করার কথা না। আমরা অন্তর থেকে জয় বাংলা স্লোগানটি দিয়েছি, উৎসাহিত হয়েছি। কাউকে বলতে হয়নি। বাধ্য করতে হয়নি। এটা মানসিক রোগ। আইন করে স্লোগান দেওয়ানো। স্লোগান হবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বঙ্গবন্ধু তো আইন করে বঙ্গবন্ধু হননি। এই নামটি তো জনগণের মাঝ থেকেই বেরিয়ে এসেছিল আমরা দেখেছি। এগুলো মানুষের অন্তর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সরকারিভাবে জয় বাংলা স্লোগানকে কাজে লাগানোর যে চেষ্টা এটি খুবই দুঃখজনক। আমি মনে করি জয় বাংলা স্লোগানটি মানুষের অন্তর থেকে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সরকার যদি জনগণকে এই স্লোগান দিতে বাধ্য করে তাহলে জয় বাংলা স্লোগানটির গুণগত পরিবর্তন হবে। সবচেয়ে দুঃখ লাগে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে রাজনীতি করছে কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না বঙ্গবন্ধু কী রাজনীতি করতেন। বঙ্গবন্ধু তো লোভে পড়ে রাজনীতি করতেন না। উনার রাজনীতি ছিল প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধু সবসময় গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চেয়েছেন। বর্তমান সরকার তো সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো চিন্তাই করছে না। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তো তারা প্রত্যাখ্যাত হবে। জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার বঙ্গবন্ধুর বিপরীত রাজনীতি করছে। দেশের মানুষের ওপর বিশেষ করে তরুণদের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। তাদের লোভ দেখিয়ে টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব না। আমি বুঝতে পেরেছি যে, তরুণরা নষ্ট হয়ে যায়নি এদের বিবেক এবং দেশপ্রেম সবই আছে। এরাই দেশের একটা পরিবর্তন আনবে। তারা বঙ্গবন্ধু’র স্বপ্নের সারথী হবে।
অনুলিখন: তামান্না মোমিন খান