মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার হাছিবুর রহমান, কিশোরগঞ্জ থেকে: দিগন্ত বিস্তৃত থই থই পানি। আবার শুকনা মৌসুমে পানি শুকিয়ে এলে বোরো ধানের আবাদ। সে হাওরের বুক চিরে পাকা সড়ক ধরে এখন ছুটে যাচ্ছে চার চাকার দ্রুতযান।
হাওরের একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হচ্ছে, ‘বর্ষায় নাও আর শুকনায় পাও’। অর্থাৎ চলাচলে নৌকাই একমাত্র ভরসা। আর শুকনা মৌসুমে পায়ে হেঁটে চলাচল। তাই বর্ষায় নৌকা ব্যবহার করা গেলেও শুকনা মৌসুমে যোগাযোগ ও পরিবহন ক্ষেত্রে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয় হাওরের বাসিন্দাদের।
হাওরের জেলা কিশোরগঞ্জে হাওর পাড়ের মানুষের মুখে এমন প্রবাদ এখন আর শোনা যাবেনা। কারণ ইতোমধ্যে বদলে গেছে কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা। এতে হাওর পাড়ের মানুষের যোগাযোগ সুবিধা বেড়েছে। সহজেই হাওরাঞ্চলে ঘুরে বেড়ানোরও সুযোগ বেড়েছে পর্যটকদের।
কিশোরগঞ্জের হাওর সমৃদ্ধ তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে সারাবছর চলাচল উপযোগী ৪৭ কিলোমিটার উঁচু পাকা সড়ক ও ৩৫ কিলোমিটার সাব-মার্সিবল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ২২টি পাকা সেতু, ১০৪টি কালভার্টসহ জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন নদীতে ৫টি ফেরি চালু করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ১২৬৮ কোটি টাকা।
গত ২৬ জানুয়ারি বালিখোলা, চামড়া, বরিবাড়ি, বলদা ও শান্তিপুরে পাঁচটি ফেরি ঘাট উদ্বোধন করেন কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের এমপি রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক ও কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের এমপি মুজিবুল হক চুন্নু। ফেরি সার্ভিস চালুর পরপরই শুরু হয় চার চাকার মোটরযান চলাচল। সাবমারসেবল ও অলওয়েদার রোডের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে ৫টি ফেরি যোগাযোগ ব্যবস্থা। যার ফলে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা থেকে প্রাইভেটকার বা বড় গাড়ি দিয়ে সরাসরি দেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করা যাবে।
এমনকি ফেরি পারাপারের ফলে এই প্রথম জেলার হাওর অধ্যুষিত থানা মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম থানায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পুলিশ বাহিনীর কর্মদক্ষতা জোরদার করার লক্ষ্যে দেয়া হয়েছে তিনটি পিকআপ ভ্যান।
মিঠামইন উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, হাওরের বুকে পাকা সড়ক ধরে আমরা যাব শহরে। এটা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। বর্ষায় মিঠামইন থেকে চামটাবন্দর হয়ে কিশোরগঞ্জ যেতে আমাদের প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা সময় লাগতো। এমনকি কিশোরগঞ্জ থেকে হাওরে বাড়ি পৌঁছাতেও গভীর রাত হয়ে যেত। এখন পাকা রাস্তা ও ফেরি হওয়াতে নিশ্চিতে একঘন্টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছতে পারছি এবং সকল প্রকার জিনিসপত্রও বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারছি।
এজন্য তারা মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
হাওরের চাকরিজীবি মো. আলাল উদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে হাওরাঞ্চলে চাকরি করছি। আগে সপ্তাহে একবার বাড়ি যেতে পারতাম। পাকা সড়ক আর ফেরি হওয়াতে এখন প্রতিদিনই কিশোরগঞ্জ থেকে এসে ইটনা উপজেলায় চাকরি করতে পারছি।
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আগে কখনই একদিনে কাজ শেষ করা যেত না। অথচ এখন দিনের কাজ দিনেই শেষ করতে পারছি। তাছাড়া পণ্য আনা নেয়ার ক্ষেত্রেও পরিবহনে কোন সমস্যা হচ্ছেনা। সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল আলম জানান, ২০১১ সালে কিশোরগঞ্জ-করিমগঞ্জ-চামড়াঘাট-মিঠামইন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়। এ প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ১৭ কিলোমিটার সাবমারসেবল রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘হাওরে পাকা সড়ক আর ফেরি চলাচলের ফলে হাওরে উৎপাদিত যাবতীয় ফসল ও হাওরের মাছ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরিবহনে সুবিধা হবে। এর ফলে হাওরাঞ্চলে অর্থনৈতিক দিক থেকেও ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।’