রাতুল মন্ডল নিজস্ব প্রতিনিধি: মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদ আব্দুল জব্বারের স্মৃতি রক্ষার্থে সরকারিভাবে তাঁর নিজ গ্রামের নাম পাঁচুয়া পরিবর্তন করে জব্বারনগর করার সিদ্ধান্ত হলেও এক যুগেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সরকার ২০০৭ সালের ২৫ মার্চ তারিখে স্থানীয় সরকার বিভাগের সভায় ভাষাশহীদ আব্দুল জব্বারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের লক্ষে তার গ্রামের নাম (জন্মস্থান) পাঁচুয়ার পরিবর্তে জব্বার নগর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে এখনও নাগরিকত্ব সনদসহ ইউপি থেকে দেওয়া নানা কাগজপত্রে গ্রামটিকে পাঁচুয়া হিসেবেই উল্লেখ হচ্ছে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহাবুল আলম জানান, তারা এখন পর্যন্ত কোনো নাম পরিবর্তনের সরকারী গেজেট পাননি। এ কারণেই ইউনিয়ন পরিষদের সকল কাগজপত্রে গ্রামের নাম পাঁচুয়া লিখছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মাহবুব উর রহমান জানান, ভাষা শহীদের গ্রামের নাম পরিবর্তন সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র কিংবা অফিস আদেশ তার কার্যালয়ে নেই।
তবে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের পুত্র মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম বাদল জানান, ১৯৯৮ সালে ভাষা শহীদের পৈতৃক ভিটা সংলগ্ন স্থানে ভাষা শহীদের নামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। দীর্ঘদিন পর বর্তমানে সেটি সরকারিকরণ হয়েছে। ২০০২ সালে উদ্যোগ নিয়ে ২০০৫ সালে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের বাড়িতে পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়েছে। গফরগাঁও উপজেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসাবে এখানেই সরকারিভাবে ২১ফেব্ররুয়ারি মহান ভাষা দিবস পালন হয়ে আসছে।
জনবল সংকটে জব্বার স্মৃতি জাদুঘর: ২০০৮ সালের ১৮ ফেব্ররুয়ারি এলজিইডির তত্ত¡াবধানে ৬২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার উদ্বোধন করেন ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন, ড. হালিমা খাতুন, বেগম রওশন আরা বাচ্চু। তবে লোকবলের অভাবে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রয়েছে। এখানে লাইব্রেরিয়ান, সহকারী লাইব্রেরিয়ান, পিয়নসহ ৫টি পদের মধ্যে শুধু লাইব্রেরিয়ান, কেয়ারটেকার ছাড়া অন্য কোনো পদে লোক নিয়োগ করা হয়নি। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এখানে লোকবল বাড়ানো প্রয়োজন বলে স্বীকার করেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ খান পাঠান। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন বলে তিনি জানান।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন : ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের পাঁচুয়া গ্রামে ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের জন্ম ১৯১৯ সালে । স্থানীয় ধোপাঘাট কৃষিবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুকাল অধ্যয়নের পরে দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া ত্যাগ করে পিতাকে কৃষিকাজে সাহায্য করেন আবদুল জব্বার। পনের বছরে নিজ খেয়ালে সবার অজান্তে গৃহত্যাগ করেন। নারায়ণগঞ্জে এসে সেখানে জাহাজ ঘাটে এক ইংরেজ সাহেবের সান্নিধ্যে আসেন। সাহেব তাঁকে একটি চাকরি দিয়ে বার্মায় (বর্তমানঃ মায়ানমার) পাঠান। সেখানে দশ-বারো বছর অবস্থান করেন।
ব্যক্তিগত জীবন :আবদুল জব্বারের পিতার নাম হাসান আলী এবং মায়ের নাম সাফাতুন নেছা। তাঁর অন্য ভাইদের নাম হচ্ছে – আবদুল কাদের ও এ,এইচ,এম আসাদ (নয়ন)। বার্মা থেকে দেশে ফিরে এসে আমেনা খাতুন নামে এক যুবতীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। আমেনা-জব্বার দম্পতির নূরুল ইসলাম বাদল নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে জব্বারের মৃত্যুর পর আমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন তার সহোদর আবদুল কাদের। আমেনা-কাদের দম্পতির রফিকুল্লাহ্, আতিকুল্লাহ্ ও রাশেদা খাতুন নামে তিন সন্তান রয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে হৃদরোগজনিত কারণে বিনা চিকিৎসায় মারা যান আমেনা খাতুন।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ:আবদুল জব্বারের পুত্র জন্ম হওয়ার কিছুকাল পরে তার শাশুড়ি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। শাশুড়িকে নিয়ে ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রয়ারী ঢাকায় আসেন। হাসপাতালে রোগী ভর্তি করে আবদুল জব্বার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রদের আবাসস্থল (ছাত্র ব্যারাক) গফরগাঁও নিবাসী হুরমত আলীর রুমে (২০/৮) উঠেন। ২১ ফেব্রæয়ারি আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হলে, কি হয়েছে দেখবার জন্য তিনি রুম থেকে বের হয়ে আসেন। তখনই পুলিশ গুলি শুরু করে এবং জব্বার আহত হন। ছাত্ররা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জব্বারকে মৃত ঘোষণা করেন। তাকে যারা হাসপাতালে নিয়ে যান, তাদের মধ্যে ছিলেন ২০/৯ নম্বর কক্ষের সিরাজুল হক।
সম্মাননা: মহান ভাষা আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকা রাখায় আবদুল জব্বারকে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করেন,।
প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে জব্বারের গ্রামে তার স্বরণে মেলা বসে। এবারও স্থানীয়দের উদ্দ্যোগে এক দিন ব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় দেশীয় সকল ধরণের পণ্যেও বাহারী আয়োজন থাকে। মেলার দুরের প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটে।