মনির হায়দার: অধিকাংশ উপন্যাস-গল্পের মতোই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক টানাপোড়েনের কাহিনী আছে এতে। আছে আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্যের বয়ান। পরিণতিহীন-অদ্ভুত এক প্রেমানুভূতির গল্প যেমন রয়েছে তেমনি আছে প্রেমহীন, আবেগহীন অন্য এক সম্পর্কের কথাও। কিন্তু যে নষ্ট সময়ে সবকিছু ক্ষমতাবানদের দখলে ও নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রক্রিয়ায় এমনকি উপন্যাসের বিষয়বস্তু নির্ধারণেও আদালতের ব্যবহার চলে তখন সর্বব্যাপী রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্বৃত্তায়নের মহোৎসব নিয়ে লেখা উপন্যাস নি:সন্দেহে তারচেয়েও বেশি কিছু হয়ে ওঠে।
‘সরকারের লোকদের কাছে দেশ হচ্ছে একটা কামধেনুর মতো। যত পারে শুষে নেবে এখান থেকে। নিজের পুত্র-কন্যা বা পরের প্রজন্মকে রাখবে বিদেশে। দেশ উজাড় হলে কী আসে-যায় তাদের? শুধু একে-তাকে কিছু সম্পদের ভাগ দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা নিয়েই তাদের একমাত্র চিন্তা।’ দুর্ভাগা প্রিয় স্বদেশ নিয়ে লেখকের এমন খেদোক্তির উল্লেখ আছে ‘ঘোর’ উপন্যাসে।
অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ সরকারি উদ্যোগে সুন্দরবনের খুব কাছেই জাতীয় স্বার্থ-বিরোধী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন, সুন্দরবনের জমি অবৈধ দখলে নিয়ে ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীর কারখানা নির্মাণ এবং যে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনাকে ঘিরে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষদেরকে ফাঁসিয়ে দেয়ার পুলিশী কাণ্ডের বিবরণ রয়েছে উপন্যাসটিতে। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ কৌশলের অংশ হিসেবে সরকারের সমালোচনাকারী অনলাইনগুলো বন্ধ করে দেয়া এবং বিরোধী দলকে ধরাশায়ী করায় সক্রিয় থাকা অনলাইনগুলো চলতে দেয়ার কথাও আছে এতে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা যে এখন চুনোপুঁটি গ্রেডের মানুষ তারও উল্লেখ আছে।
তবে সবচেয়ে খোলামেলাভাবে আছে মিডিয়ার পঁচনের গল্প। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকা অসাধু ব্যবসায়ীদের অবৈধ ধান্দার স্বার্থে মিডিয়ার মালিক বনে যাওয়া, ক্ষমতাসীনদের নির্লজ্জ দালালরা পত্রিকার সম্পাদক থেকে শুরু করে মিডিয়ার বড় বড় পদে আসীন হওয়া, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে নিরুপায় হয়ে স্রেফ চাকরি করা এবং মেধাবী ও পেশাদার সাংবাদিকদের ক্রমশঃ কোনঠাসা হয়ে পড়ার মতো আমাদের দীর্ঘদিনের চেনা দৃশ্যগুলোর সহজ বয়ান আছে উপন্যাসটিতে।
অবশ্য এই উপন্যাসের মূল চরিত্রটি দারুন ইতিবাচক ও প্রেরণাদায়ী। একজন সাধারণ রিপোর্টার সাইফুলের অসাধারণ নীতিবোধ ও সাহসিকতার দৃষ্টান্ত যেন সংক্ষুব্ধ ও হতাশ মানুষদের নিরব আকাঙ্ক্ষারই প্রকাশ। এক কথায় বলতে গেলে ‘ঘোর’ চলতি সময়েরই এক প্রতিচ্ছবি মাত্র। আসিফ ভাই যথার্থই তাঁর অসাধারণ উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন তিনজন তারকা সাংবাদিককে। ব্যক্তিগতভাবে আমি খালেদ মুহিউদ্দীন, রোজিনা ইসলাম ও বদরুদ্দোজা বাবুর গুনমুগ্ধ। তাঁদের প্রত্যেককে অভিনন্দন। ‘ঘোর’ এবং তার স্রষ্টার জন্য শুভকামনা। বইটি বের করেছে প্রথমা।