রাত পোহালেই ঢাকার দুই সিটিতে ভোট। ২১ দিনের বিরামহীন প্রচার-প্রচারণা থেমে গেল মধ্যরাত থেকে। এখন ভোটের অপেক্ষায় প্রার্থী এবং ভোটাররা। প্রায় ৫৫ লাখ ভোটারের দুই সিটিতে চোখ পুরো দেশবাসীর। ঢাকায় চোখ পুরো দুনিয়ার। কেমন হবে নির্বাচন? কেমন থাকবে ভোটের দিনের পরিবেশ এমন আলোচনা এখন চারপাশে। পাল্টাপাল্টি নানা অভিযোগ এসেছে। কেন্দ্র দখল, কেন্দ্র পাহারার কথাও এসেছে প্রার্র্থী এবং তাদের দলের নেতাদের মুখ থেকে।
কেন্দ্র দখল করতে ভাড়াটে সশস্ত্র সন্ত্রাসী ঢাকায় আনা হয়েছে এই অভিযোগ এসেছে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের তরফে। এবারই প্রথম দুই সিটিতে ইভিএমে পুরো ভোট গ্রহণ করা হবে। ঢাকাবাসীর জন্য এটি হবে নতুন অভিজ্ঞতা। আগের ভোটগুলোতে রাতেই ভোট দেয়া, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগ ছিল। কিন্তু এবার ইভিএমে ভোট কাস্ট করতে হলে ভোট লাগবে। তাই ভোটারদেরও কেন্দ্রে যেতে হবে। ঢাকার ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে নির্বিঘ্নে যেতে পারবেন কিনা, যেতে চাইবেন কিনা এমন প্রশ্ন খোদ প্রার্থীদেরও। তারা বলছেন, অতীতের অভিজ্ঞতা ভোটাদের জন্য সুখকর নয়। তাই তাদের কেন্দ্রমুখি করতে ভোটের দিনের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাতাসে নানা কিসিমের গুজব-গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে। বলা হচ্ছে-যে বোতামেই টিপ দেন না কেন ভোট একটা নির্দিষ্ট প্রতীকেই পড়বে। দিনের শেষে যতো ভোটই পড়ুক যন্ত্রে গণনাটা হবে গুরুত্বপূর্ণ। সেই গণনা কিভাবে হবে সেটিও হবে দেখার বিষয়। আলোচনায় আছে আগের ভোটগুলোর মতো কেন্দ্রের বাইরে প্রভাবশালী প্রার্থীদের পক্ষে ‘জটলা কৌশল’। বলা হচ্ছে, ইভিএমের এক বোতামে টিপ দেয়ার পর ভোট হয়ে গেছে বলে ভোটের সুযোগটি নিতে পারে তৃতীয় কেউ।
বাতাসে ভেসে বেড়ানো এসব গুজব আর গুঞ্জনকে মিথ্যা প্রমাণ করে শান্তিুপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য ভোট অনুষ্ঠানের বিশাল এক চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনের সামনে। ভোট সুষ্ঠু করার চ্যালেঞ্জ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেও। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করতে পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থার অন্তত ৪০ হাজার কর্মী কাজ করবেন। গত রাত থেকে বিজিবি টহলে নেমেছে। ভোট সামনে রেখে নগরজুড়ে কাজ করবে র্যাবের দেড়শ টিম। কিছু ঘটনাছাড়া শান্তিপূর্ণ প্রচার শেষ হওয়ায় নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশন ও আইন শৃঙ্কলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব।
গতকাল কেন্দ্রে কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়েছে অনুশীলনমূলক (মক ভোটিং) ভোট। ইভিএম পরিচালনার জন্য প্রতিটি কেন্দ্রে ইসির প্রশিক্ষিত কর্মতর্কা ছাড়াও দুই জন করে সেনা সদস্য রাখা হবে। সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইসি। গতকাল ৩০শে জানুয়ারি মধ্যরাত (রাত ১২টা) থেকে ২রা ফেব্রুয়ারি ভোর ৬টা পর্যন্ত মোট ৫৪ ঘণ্টা মোটরসাইকেল চলাচল নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, এছাড়া আজকে (৩১জানুয়ারি) মধ্যরাত (১২টা) থেকে (১ ফেব্রুয়ারি) আগামীকাল নির্বাচনের দিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইসি। তবে দুই সিটির রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে এবং নির্বাচন কমিশন থেকে সরবরাহ করা স্টিকার ও পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মোটরসাইকল ও বিভিন্ন যানবাহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা রাখা হয়েছে। বিশেষ করে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের এজেন্ট, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক, নির্বাচনে সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবেন। সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্রের পাশাপাশি ইসি থেকে সরবরাহ করা স্টিকার ও তাদের নিজেদের অফিসের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচন উপলক্ষে আজকে মধ্যরাত থেকে আগামীকাল ভোটেরদিন মধ্যরাত পর্যন্ত (২৪ ঘন্টা) লঞ্চ, স্পীড বোটসহ সকল ধরণের ইঞ্জিন চালিত নৌযান বন্ধ থাকবে।
এদিকে, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই সিটির ২ হাজার ৪৬৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ১ হাজার ৫৯৭ টি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ (গুরুত্বপূর্ণ) ঘোষণা করেছে ইসি। এরমধ্যে দক্ষিণে ১ হাজার ১৫০ টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭২১ টি ও উত্তর সিটিতে ১ হাজার ৩১৮টি কেন্দ্রে মধ্যে ৮৭৬ টি কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন। ঝুঁকির্পণূ কেন্দ্রগুলোতে নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে ২জন বেশি পুলিশ সদস্য রাখা হয়েছে। সাধারণ ওয়ার্ডে ১৬জন ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ১৮ জন আইন শৃংঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়ন থাকবে।
সিটি নির্বাচনে কোনো ঝুঁকি নেই-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কোনো ঝুঁকি নেই। পরিস্থিতি পুরোপুরি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সুন্দরভাবেই সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। গতকাল রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়ে আয়োজিত সরস্বতী পূজা পরিদর্শনকালে তিনি এসব কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, নির্বাচনের সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। ইসি যেভাবে যেখানে মনে করছে, সেখানেই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছে। গোপীবাগে ইশরাকের নির্বাচনী প্রচারণায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষের বিষয়ে আসাদুজ্জামান খান বলেন, আওয়ামী লীগের একটি অফিস লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। প্রচারণা থেকে গুলি করা হয়েছে। এ ঘটনায় একজনকে শনাক্ত করে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুধু ওই ঘটনাই নয়, বুধবার গুলশানে নির্বাচনী প্রচারণায় সংঘর্ষের ঘটনায়ও জড়িতের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি আরও বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। তারা যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে। ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আগামী ১লা ফেব্রুয়ারি সুন্দর পরিবেশে ভোট দিয়ে ভোটাররা তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে জয়ী করবেন।
প্রচারণা চালানো আত্মীয়দের ঢাকা ছাড়ার নির্দেশ: ঢাকা সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার-প্রচারনায় যোগ দিতে যারা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন তাদেরকে দুইদিনের মধ্যে ঢাকা শহর ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থীর ক্যাম্পেইন করার জন্য যারা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছিলেন, আপনার দুইদিনের মধ্যেই চলে যান। এটা আমাদের নির্দেশনা। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে অপ্রেেয়াজনীয় কোনো লোকের অপতৎপরতা আমরা চাই না। আজ (গতকাল) বৃহস্পতিবার রাতেই প্রচারণা শেষ হয়ে যাবে। যদি কেউ থেকেও যান, আশা করবো, আপনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন। তিনি নগরবাসীকে কোন সস্ত্রাসী, ম্যানহোলের ঢাকনা চুরিকারী, মাদক ব্যবসায়ী ও ছিনতাইকারীকে ভোট না দিতে পরামর্শ দেন। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে ঢাকা সিটি নির্বাচনকে ঘিরে করা এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
বেনজীর আহমেদ বলেন, আসন্ন নির্বাচনে র্যাব বহুমুখী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে নাম অনুযায়ী প্রতিটি কেন্দ্র আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা প্রতিটি কেন্দ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবো। একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। যাতে প্রতিটি ভোটার নিরাপদ পরিবেশে ভোট প্রদান করতে পারে। তারা যাকে ইচ্ছে তাকে ভীতিমুক্ত পরিবেশে ভোট প্রদান করতে পারেন। গত নির্বাচনের চেয়ে এবার বেশি র?্যাব সদস্য মাঠে থাকবে। প্রতিটি কেন্দ্রে র?্যাবের নেতৃত্বে একটি করে পেট্রোলিং থাকবে। ঢাকায় পাঁচটি ব্যাটালিয়ন রয়েছে, স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকবে। যাতে যেকোনো আপদকালীন পরিস্থিতি অল্প সময়ের মধ্যে মোকাবিলা করতে পারি। কমান্ড বাহিনী ছাড়াও হেলিকপ্টার, ডগ স্কোয়াড মোতায়েন থাকবে। তাছাড়া ২৪ আওয়ার স্পেশাল মনিটরিংয়ে থাকবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যারা আছেন আমরা প্রত্যাশা করবো, তারা গণতন্ত্র ও মূল্যবোধ প্রদর্শন করবেন। কোনো ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি করবেন না, কেউ যদি কোনো কারণে সংক্ষুব্ধ হন তাহলে আইনের আশ্রয় নিন। আমরা সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। সংবাদ সম্মেলনে এসময় অন্যানের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) জামিল আহমেদ, র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম ও র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের সহকারী পরিচালক মেজর রইসুল আজম মনি প্রমুখ কর্মকর্তারা।