মানিকগঞ্জ:পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় মা মাহমুদা বেগমকে (৪৫) ফেসবুক প্রেমিক ও তার বন্ধুদের দিয়ে হত্যা করায় মেয়ে জুলেখা আক্তার জ্যোতি। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে বুধবার (২২ জানুয়ারী) সকালে মানিকগঞ্জ শহরের দক্ষিণ সেওতা এলাকায় নিজ বাড়িতে শ্বাসরোধে খুন করা হয় মাহমুদা বেগমকে। এই হত্যায় অংশ নেয় জ্যোতির ফেসবুক প্রেমিক নাঈম ইসলাম ও তার তিন সহযোগী।
সোমবার বিকেলে মানিকগঞ্জ চীফ জুডিশিয়াল আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাকিল আহমেদের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয় গ্রেফতার জ্যোতি, নাঈম ও নাঈমের সহযোগি রাকিব।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মানিকগঞ্জ সদর থানার এসআই শামীম আল মামুন জানান, মাহমুদা বেগমকে নিজ ঘরে খাটের ওপর লেপচাপায় শ্বাসরোধে হত্যার পর, জ্যোতিকে হাত-পা-মুখ বেঁধে হত্যা ও স্বর্ণালংকার লুটের নাটক সাজায় তারা। কিন্তু একদিনের মাথায় পুলিশের তদন্তে তা ফাঁস হয়ে যায়।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, বুধবার সকালে হত্যাকাণ্ডের সময় বাড়িতে থাকা নিহতের একমাত্র মেয়ে জ্যোতিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই দিনই থানায় ডেকে নেন তারা।
জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে হত্যাকাণ্ডের সাথে তার সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে জ্যোতি। বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার দেখিয়ে শুক্রবার বিকেলে তাকে মানিকগঞ্জ চীফ জুডিশিয়াল আদালতের মানিকগঞ্জ সদরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটেটের কাছে প্রেরণ করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অধিকতর তথ্য আদায়ের লক্ষ্যে আদালতের বিচারকের কাছে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। বিচারক ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
শুক্রবার বিকেলে, নিহতের স্বামী জহিরুল ইসলাম বাদী হয়ে মানিকগঞ্জ সদর থানায় মেয়ে জ্যোতি আক্তার, তার কথিত ফেসবুক প্রেমিক নাঈম ইসলাম এবং তার সহযোগি রাকিব ও অন্য দুই সহযোগির বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ দায়ের করেন। তদন্তের স্বার্থে ওই দুই সহযোগির নাম পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে।
শুক্রবার রাতে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে, জ্যোতি আক্তার তার মায়ের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার রাতেই তার কথিত প্রেমিক কেরানীগঞ্জের আরাকুল গ্রামের খোরশেদ আলমের ছেলে নাঈম ইসলাম (২৫) এবং তার সহযোগি একই গ্রামের মৃত আব্দুল বারেকের ছেলে রাকিবকে (২৫) গ্রেফতার করে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত আরো দুই সহযোগিকে গ্রেফতারের জোর চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, জ্যোতির সাথে মোবাইল ফোন ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে আলাপচারিতায় ৮ মাস আগে ভোলা জেলার নির্মাণ শ্রমিক নাঈমের সাথে জ্যোতির প্রেম এবং দৈহিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। তার সাথে বিয়ে দিতে নারাজ হন মা। তাই তিন মাস আগে জ্যোতি ও নাঈম পরিকল্পনা করে তাকে হত্যা করার।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, মঙ্গলবার রাতেই নাইম ও তার ৪ সহযোগি জ্যোতির ঘরে প্রবেশ করে। রাতে কয়েক দফা চেষ্টা করেও হত্যার সুযোগ পায়নি। সকাল ৭টার দিতে জ্যোতির বাবা ফজরের নামাজ শেষে প্রাতভ্রমণে বের হলে তারা মাহমুদা বেগমকে হত্যা করে।
নিহতের স্বামী জহিরুল ইসলাম জানান, তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে তার নিজস্ব পাঁচতলা ভবনের দোতলার একটি ইউনিটে বসবাস করেন। তিনি ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত কাতারে প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে এসে পোল্ট্রি ব্যবসা শুরু করেন। তিন বছর আগে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট উচ্ছেদের সময় তার দোকান ভাঙ্গা পড়ে।
ব্যবসা বাদ দিয়ে ২০১৫ সালে তিনি জেলা শহরের সেওতা এলাকায় গড়ে তোলেন এই পাঁচতলা ভবন। বছর তিনেক আগে মেয়ে জ্যোতি আক্তারকে বিবাহ দেন ঢাকার ধামরাই এলাকার মারুফ সরকারের সাথে। কিন্তু মেয়ের নানা নৈতিক স্খলনের কারণে সেই স্বামীর সাথে ৩ মাস আগে বিচ্ছেদ ঘটে। ৩ মাস ধরে মেয়ে তাদের সাথে থাকে। একমাত্র ছেলে মাজহারুল ইসলাম তুহিন (১৫) মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা এলাকায় একটি আবাসিক মাদ্রাসায় থেকে পড়ে।
আবেগ তাড়িত হয়ে তিনি বলেন, ২০১০ সালে তিনি তার স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে পবিত্র হ্জ্জ পালন করেছেন। হত্যাকাণ্ডের আগের রাতেও তার স্ত্রী তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু মেয়ের এই নৈতিক স্খলনের কারণে তিনি তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন।