কথায় বলে, ‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে।’ কিন্তু এবার মাঘের আগেই কাঁপন লেগেছে সারাদেশে। পৌষ মাসেই তীব্র শীতের কামড়ে স্থবিরতা নেমে এসেছে জনজীবনে। তবে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মাঘের প্রথম কয়েক দিন শীত থাকলেও সচরাচর দ্বিতীয় পক্ষেই তা কমে আসে।
তাপমাত্রার মানদণ্ডে গত দু’দিনের আবহাওয়া পরিস্থিতিকে ‘মৃদু শৈত্যপ্রবাহ’ বলতে হবে। তবে উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে শীতের অনুভূতি ছিল আরও বেশি। জানুয়ারির স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে গত দু’দিনের তাপমাত্রা। সঙ্গে ছিল উত্তর-পশ্চিমের বাতাসের অস্বাভাবিক গতিবেগ।
আগারগাঁও আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন সমকালকে বলেন, সূর্যের আলো কম থাকায় শনিবার ঢাকায় শীতের তীব্রতা বাড়ে। সঙ্গে যোগ হয় উত্তরের হিমেল হাওয়া। সাধারণত ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার বেগে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাতাস ছুটে এলেই তীব্র হয় শীতের অনুভূতি। সেখানে গতকাল রোববার বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রায় ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত।
আবহাওয়াবিদ আরিফ বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি এলাকায় সূর্য দেখা গেলেও সেভাবে কিরণ ছড়াতে পারেনি। দিনের বেলায় ঘন কুয়াশার কারণে তাপমাত্রা অনেক নিচে নেমে আসে। গতকালও ঢাকায় দিনের তাপমাত্রা ছিল ১৭.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সারাদেশের মধ্যে সর্বনিম্ন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের গত ৩০ বছরের রেকর্ড পর্যালোচনায় জানুয়ারি মাসের দিন ও রাতের স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রা থাকার কথা যথাক্রমে ২৫ ও ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রকাশিত রাতের তাপমাত্রার গড় ছিল ১২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতের তাপমাত্রায় বড় রকম হেরফের দেখা না গেলেও বড় ফারাক ছিল দিনের তাপমাত্রার ক্ষেত্রে। গত শনিবার সারাদেশে দিনের তাপমাত্রার গড় ছিল ১৮.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাতের তাপমাত্রা বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, শনিবার সবচেয়ে কম তাপমাত্রা ছিল রংপুর বিভাগে- ১০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া ঢাকা বিভাগে ১২.২, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৩.৫, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩.৯, সিলেট বিভাগে ১২.২, রাজশাহী বিভাগে ১০.৯, খুলনা বিভাগে ১১.৯ এবং বরিশাল বিভাগে ১২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল।
দিনের তাপমাত্রার গড়ে শনিবারের ‘শীতলতম’ বিভাগ ঢাকা। রাজধানী ঢাকায় ওইদিনের তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি হলেও বিভাগীয় হিসাবে তা দাঁড়ায় ২০.১ ডিগ্রিতে। এ ছাড়া দিনের তাপমাত্রা ছিল ময়মনসিংহ বিভাগে ২২.৭, চট্টগ্রাম বিভাগে ২১.৬, সিলেট বিভাগে ২০.৪, রাজশাহী বিভাগে ২১.৫, রংপুর বিভাগে ২১.৭, খুলনা বিভাগে ২১.৪ এবং বরিশাল বিভাগে ২২.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গতকাল সকালে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল রাজারহাটে- ৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা মৃদু শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে বিবেচিত। এ দিন ঈশ্বরদী, তেঁতুলিয়া এবং চুয়াডাঙ্গায়ও বয়ে যায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। তাপমাত্রার মানদণ্ডে এটি ‘মৃদু’ হলেও শীতের অনুভূতি ছিল তীব্র।
আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, রাতের তাপমাত্রা কমে গেলেও মানুষের মধ্যে সেটি প্রভাবক হতে পারে না। কিন্তু দিনের তাপমাত্রা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা যদিও ৩৭.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অন্তত ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপকে সহনীয় বলা যায়।
আরিফ হোসেন বলেন, দিনের তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে, সেটি মানুষের কাছে অস্বাভাবিক লাগে না। তবে এর নিচে নামলে হয়ে ওঠে অস্বস্তির কারণ। সে বিবেচনায় গত দু’দিনের তাপমাত্রা ছিল সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক কম।
তিনি বলেন, দেশে সাধারণত নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসকে শীতপ্রবণ ধরা হয়। সে হিসেবে মাঘের পুরো মাস শীতের অনুভূতি সেরকম থাকে না। বড়জোর মাসের প্রথম ১৫ দিন শীত থাকে।
আরিফ হোসেন বলেন, ‘অনেকেরই ধারণা, মাঘই হলো শীতের আসল মাস। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মাঘ মাসের প্রথম কয়েকদিন পর্যন্ত শীত থাকে। গ্রামাঞ্চলে এখন অনেক পাকা বাড়িঘর নির্মাণ হয়েছে। ফলে শীতের মাত্রা আগের মতো থাকলেও অনেক সময় অনুভূতিটা তত তীব্র হয় না।’
এই আবহাওয়াবিদের মতে, মাঝেমধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা অনেক নিচে নেমে গেলেও সেটি কতটা স্থায়ী হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে শীতের তীব্রতা। ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি দেশের ইতিহাসের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার (২.৬ ডিগ্রি) প্রসঙ্গ তুলে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, ওই তাপমাত্রা যদি বড়জোর তিন দিন অব্যাহত থাকত, তাহলেই পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠত।
গত দু’দিনের আবহাওয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, শনিবার দেশের ৫০টির বেশি জেলায় সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। ঢাকাও ছিল কুয়াশাঢাকা। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে অনেক অঞ্চলে দিনেই নেমে আসে আঁধার। গতকালও ছিল একই পরিস্থিতি। এর প্রভাব পড়ে জনজীবনে।
চলতি শীত মৌসুমে গতকাল পর্যন্ত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়ায়। গত ২৯ ডিসেম্বর সেখানে রাতের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ডিসেম্বরে একাধিক শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেলেও জানুয়ারির শুরুতে শীত নেমে আসে স্বাভাবিক অনুভূতিতে। সঙ্গে যোগ হয় বৃষ্টি। শীত মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টির রেকর্ড ছাড়িয়ে প্লাবিত হয় অনেক এলাকা। ৩ জানুয়ারি এক দিনেই রেকর্ড হয় জানুয়ারির স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের প্রায় আড়াই গুণ।
পৌষের শেষ মুহূর্তে নেমে আসা পারদে জনজীবনে নেমে এসেছে অচলাবস্থা। ঢাকার বিভিন্ন সড়কে ছিন্নমূল মানুষকে দিনের বেলায় খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে দেখা গেছে। মহাসড়কে দিনে যানবাহন চলাচল করেছে হেডলাইট জ্বালিয়ে। তীব্র ঠান্ডায় ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে।
তেজগাঁও কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী সাদমান বলেন, সকালে বাসার বাইরে পা রাখতেই পুরো শরীর হিম হয়ে আসে। অনেক শিক্ষার্থী বাসা ছেড়ে বের হচ্ছেন না। কলেজে উপস্থিতি নেমে এসেছে ১০ ভাগের নিচে।
এদিকে পৌষ মাস শেষ হতে আরও দুই দিন বাকি। মাসের শেষ দু’টি দিনেও পরিস্থিতি এমন থাকার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।