টঙ্গী: আনুষ্ঠানিকভাবে ইজতেমা শুরু এক দিন আগেই জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে টঙ্গীর তুরাগ তীর ও আশপাশের এলাকা। এবারের ইজতেমায় তাবলিগ সাথীদের উপস্থিতি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মূল ময়দানে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় তাবলিগ সাথীরা আশপাশের রাস্তাঘাট, ফুটপাথ, খোলা জায়গা, খেলার মাঠ, এমনকি ইজতেমা ময়দানের বহুতল টয়লেট ভবনগুলোতেও অবস্থান নিয়েছে।
এক দিন আগেই নজিরবিহীন এমন জমায়েত মোকাবেলায় প্রস্তুত ছিলেন না ইজতেমার আয়োজক তাবলিগের আলমে শূরা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় গাজীপুর সিটি মেয়র মো: জাহাঙ্গীর আলম নগরবাসীর আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেছেন।
ইজতেমা ময়দানের আশপাশের ব্যক্তি মালিকানাধীন খোলা জায়গায় তাবলিগ সাথীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য তিনি নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। এদিকে ইজতেমা অভিমুখী এই জনস্রোতের কারণে আশপাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতেও তীব্র যান ও জনজটের সৃষ্টি হয়েছে।
গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তা থেকে উত্তরা আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের প্রায় ১৩ কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানজটের কারণে মহাসড়কটি কার্যত অচল হয়ে যায়। বিশ্ব ইজতেমার বিগত ৫৫ বছরের ইতিহাসে এমন উপস্থিতি দেখা যায়নি বলে তাবলিগ সাথীরা জানান।
ময়দানে ধারণক্ষমতার বহুগুণ বেশি তাবলিগ সাথীদের উপস্থিতির কারণে খাবার, পানি, অজু, গোসল, পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটাতে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে আগত মুসল্লিরা। এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত দেশের প্রায় ৫০০ বিদেশী মুসল্লি ইজতেমায় শরিক হয়েছেন।
আজ শুক্রবার বাদ ফজর থেকে আম (সার্বিক) বয়ানের মধ্য দিয়ে ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও এক দিন আগেই ময়দান কানায় কানায় পরিপূর্ণ হওয়ায় বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী ময়দানে খণ্ড খণ্ডভাবে বয়ান হয়।
এমনকি একপর্যায়ে বাদ আসর থেকেই শুরু হয়ে যায় আম বয়ান। তাবলিগ জামাতের মিডিয়া সমন্বয়কারী মুফতি জহির বিন মুসলিম জানান, বৃহস্পতিবার বাদ আসর থেকেই ময়দানে আম বয়ান শুরু হয়েছে। এ দিন বাদ আসর থেকে মাগরিবের আগ পর্যন্ত আম বয়ান করেন তাবলিগ জামাতের পাকিস্থানি মুরব্বি মাওলানা ফাহিম, মাগরিবের পর থেকে এশার আজান পর্যন্ত বয়ান করেন ভারতের তাবলিগ মুরব্বি ইব্রাহিম দেওলা।
তবে আজ বাদ ফজর পাকিস্তানের মাওলানা খুরশিদ আলমের আম বয়ানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে তাবলিগ জামাতের আলমে শূরার ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা। ইজতেমা ময়দানে উপমহাদেশের বৃহত্তর জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে। জুমার নামাজে ইমামতি করবেন স্বাগতিক বাংলাদেশের তাবলিগ মুরব্বি রাজধানীর কাকরাইল মারকাজ মসজিদের খতিব মাওলানা জুবায়ের হাসান। আগামী রোববার আখেরি মুনাজাতও তিনিই পরিচালনা করবেন।
এদিকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো: আনোয়ার হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ইজতেমায় জিএমপির নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আজকের দিনটির জন্য আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলাম না। আজ (বৃহস্পতিবার) বেলা ২টার পর থেকে আমাদের মূল দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল।
কিন্তু গত (বুধবার) রাতেই ইজতেমা ময়দান ভরে যায়। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল শুক্রবারের জুমা ও আখেরি মুনাজাতের দিনের চাপ সামলানো। এক দিন আগেই মুসল্লিরা এসে পড়ায় চারদিকে যানবাহনের চাপ বাড়ছে এবং আমাদের দায়িত্বও বেড়ে গেছে। তবে আমরা যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত আছি।
আগামীতে ইজতেমা একটাই হবে : এদিকে বৃহস্পতিবার বিশ্ব ইজতেমার সার্বিক কার্যক্রম তদারকি করতে ময়দানে আসেন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মো: আব্দুল্লাহ, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো: জাহিদ আহসান রাসেল এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অ্যাডভোকেট মো: জাহাঙ্গীর আলম।
ইজতেমায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প উদ্বোধনের সময় ধর্মপ্রতিমন্ত্রী বলেন, গত বছর আমাদের ছোটখাটো যত ভুলত্রুটি ছিল সবগুলোকে একত্র করে আমরা এ বছর ব্যবস্থা নিয়েছি। ফলে অন্যান্য বছরের তুলনায় ইজতেমার সব কর্মকাণ্ড সুন্দরভাবে সফল হবে।
তিনি আরো বলেনন, আগামীতে সব পক্ষকে একত্র করে আমরা একটি ইজতেমা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করব। তিনি বলেন, অন্যান্যবার জুমার আগে যা দেখা যায়নি, এবার ইজতেমার এক দিন আগেই তা দেখা যাচ্ছে। এ বছর ইজতেমায় এত লোক আসবে আমরা বুঝতে না পারলেও প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন বলেই আমাদের সংশ্লিষ্ট সকলকে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ইচ্ছা করলে কেউ কোনো বিশৃঙ্খলা করতে পারবে না। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ইজতেমায় দায়িত্ব পালন করছে।
যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো: জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, আগে ইজতেমায় চট দিয়ে কাঁচা টয়লেট তৈরি করা হতো। এখন কাঁচা টয়লেট নেই বললেই চলে। ইজতেমায় আমরা ৩১টি বহুতল টয়লেট ভবন নির্মাণ করেছি। আগে ইজতেমায় তিনটি গভীর নলকূপ ছিল, আমরা আরো ১০টি গভীর নলকূপ করেছি। এ ছাড়া আমরা মাঠ সমতলকরণ, গ্যাসলাইন সংযোগ ও রাস্তা প্রশস্ত করেছি। ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেন ও ফুটপাথসহ ইজতেমার প্রধান সড়ক কার্পেটিং করেছি। প্রধানমন্ত্রী ইজতেমায় প্রত্যেকটি সংস্থাকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমাদের কর্মকাণ্ড প্রতিদিনই অব্যাহত আছে।
ইজতেমায় একজনের মৃত্যু : বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ইজতেমা ময়দানের নির্ধারিত খেত্তায় যাওয়ার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইয়াকুব শিকদার (৭৫) নামের একজন মুসল্লি মারা যান। তার বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া উপজেলার লাখির পাড় গ্রামে।
বিশেষ ট্রেন : বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে আজ থেকে ১২ জানুয়ারি এবং ১৭ থেকে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন গন্তব্যে বিশেষ ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।
১১ ও ১৮ জানুয়ারির সূচি অনুযায়ী বিশেষ ট্রেন চলবে : জামালপুর-টঙ্গী স্পেশাল ট্রেন জামালপুর ছাড়বে সকাল ৯:১৫ মি. এবং টঙ্গী স্টেশনে পৌঁছাবে বেলা ২:১৫ মি.।
১০ ও ১৭ জানুয়ারি জুম্মা স্পেশাল ট্রেনের সময়সূচি হচ্ছে : ঢাকা- টঙ্গী স্পেশাল ট্রেন ঢাকা ছাড়বে সকাল ১০-২০ মি. টঙ্গী পৌঁছাবে ১১:২০ মি.। টঙ্গী-ঢাকা স্পেশাল ট্রেন টঙ্গী ছাড়বে বেলা ২-৫০ মি., ঢাকা পৌঁছাবে বিকেল ৩-৫০ মি.।
আখেরি মুনাজাতের দিন ১২ ও ১৯ জানুয়ারির সূচি অনুযায়ী ট্রেন চলবে : ঢাকা-টঙ্গী স্পেশাল ট্রেন-১ ঢাকা ছাড়বে ভোর ৫-২৫ মি., টঙ্গী পৌঁছাবে ভোর ৬-১৫ মি.।
ঢাকা-টঙ্গী স্পেশাল ট্রেন-২ ঢাকা ছাড়বে সকাল ৭-১৫ মি., টঙ্গী পৌঁছাবে সকাল ৮-১০ মি.।
ঢাকা-টঙ্গী স্পেশাল ট্রেন-৩ ঢাকা ছাড়বে সকাল ৭-৩০ মি., টঙ্গী পৌঁছাবে সকাল ৮-৩০ মি.।
ঢাকা-টঙ্গী স্পেশাল ট্রেন-৪ ঢাকা ছাড়বে সকাল ৯-৪৫ মি., টঙ্গী পৌঁছাবে সকাল ১০-৪৫ মি.।
ঢাকা- টঙ্গী স্পেশাল ট্রেন-৫ ঢাকা ছাড়বে সকাল ১০-২৫ মি., টঙ্গী পৌঁছাবে বেলা ১১-৩০ মি.।
টঙ্গী-ঢাকা স্পেশাল-১ টঙ্গী ছাড়বে দুপুর ১২-৪০ মি., ঢাকা পৌঁছাবে বেলা ১-৩৫ মি.।
টঙ্গী-ঢাকা স্পেশাল-২ টঙ্গী ছাড়বে দুপুর ১২-৪০ মি., ঢাকা পৌঁছাবে বেলা ১-৩৫ মি.।
টঙ্গী-ঢাকা স্পেশাল-৩ টঙ্গী ছাড়বে বেলা ২-১৫ মি., ঢাকা পৌঁছাবে বেলা ৩-১০ মি.।
টঙ্গী-ঢাকা স্পেশাল-৪ টঙ্গী ছাড়বে বিকাল ৪-২০ মি., ঢাকা পৌঁছাবে বিকাল ৫-২০ মি.।
টঙ্গী-ময়মনসিংহ-১ টঙ্গী ছাড়বে দুপুর ১২-২০ মি., ময়মনসিংহ পৌঁছাবে বেলা ৩-৫৫ মি.।
টঙ্গী-ময়মনসিংহ-২ টঙ্গী ছাড়বে দুপুর ১২-৪০ মি., ময়মনসিংহ পৌঁছাবে বিকেল ৪-৫৫ মি.।
টঙ্গী-টাঙ্গাইল স্পেশাল টঙ্গী ছাড়বে দুপুর ১২-৫০ মি., টাঙ্গাইল পৌঁছাবে বেলা ২-২০ মি.।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, বিশ্ব ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের সুবিধার্থে ৮ জানুয়ারি দুপুরের পর থেকে ১২ জানুয়ারি আখেরি মুনাজাতের পূর্ব দিন পর্যন্ত এবং ১৬ জানুয়ারি দুপুরের পর থেকে ১৯ জানুয়ারি আখেরি মুনাজাতের পূর্ব দিন পর্যন্ত ঢাকা অভিমুখী সব ট্রেনের টঙ্গী স্টেশনে ২ মিনিট বিরতি থাকবে।
আগামী ১৩ ও ১৯ জানুয়ারি আখেরি মুনাজাতের দিন (সোনার বাংলা ট্রেন ব্যতীত) সব আন্তঃনগর ট্রেন ও মেইল এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো টঙ্গী স্টেশনে ২ মিনিট বিরতি থাকবে।
আগামী ১২ ও ১৯ জানুয়ারি সুবর্ণ এক্সপ্রেস ও বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেন বন্ধ থাকবে। তবে ১৩ ও ২০ জানুয়ারি সোমবার সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেন এবং ১২ ও ১৯ জানুয়ারি সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেন সাপ্তাহিক বন্ধের দিনও চলাচল করবে।
১২ ও ১৯ জানুয়ারি আখেরি মুনাজাতের দিন ঢাকা-কালিয়াকৈর ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মধ্যে ডেমু (কমিউটার) ট্রেনগুলো চলাচল বন্ধ থাকবে।
আখেরি মুনাজাতের পরদিন অর্থাৎ ১৩ ও ২০ জানুয়ারি বহির্গামী টিকিটধারী মুসল্লিদের ফেরত যাওয়া ও টঙ্গী স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠার সুবিধার্থে সুন্দরবন, পারাবত, ধূমকেতু, এগারসিন্দুর প্রভাতী, তিস্তা, নীলসাগর, মোহনগঞ্জ, অগ্নিবীণা, একতা, কিশোরগঞ্জ, জয়ন্তীকা, সিল্কসিটি, উপকূল, কালনী, ব্রহ্মপুত্র, চিত্রা, দ্রুতযান, মহানগর প্রভাতী, রংপুর, যমুনা, সিরাজগঞ্জ, হাওর, উপবন, লালমনি, বেনাপোল, কুড়িগ্রাম ও মহানগর গোধূলি এক্সপ্রেস ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে ২ মিনিট করে থামবে বলে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।