ঢাকা: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ। ১৯৭২ সালের এই দিনে স্বাধীন স্বভূমে পা রেখেছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা। কোটি বাঙালির আবেগমথিত এই দিনটি এবার হাজির হয়েছে অন্য মহিমায়। আগামী ১৭ই মার্চ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে শতবর্ষে পা রাখতেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক শততম জন্মবার্ষিকীকে স্মরণীয় করে রাখতে বছরজুড়ে পালিত হবে নানা কর্মসূচি।
বছরটিকে ঘোষণা করা হয়েছে মুজিববর্ষ হিসেবে। শুধু কর্মসূচিতেই নয়, মুজিববর্ষে আওয়ামী লীগ ও সরকার জনগণের প্রতি অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানাতে চায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি। দল এবং সরকারের পক্ষ থেকে এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলা হচ্ছে এই বছরে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি দল এবং সরকারকে আরো জনবান্ধব করার উদ্যোগ নেয়া হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি জাতির দ্রষ্টা এবং স্থপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে এখনো পরিপূর্ণ সম্মান দেয়া যায়নি। সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে জাতির পিতা হিসেবে তাকে সর্বোচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠা করাই হওয়া উচিত জন্মশতবার্ষিকীর অঙ্গীকার। বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন, মাত্র ১৩১৫ দিনের মেয়াদকালে বঙ্গবন্ধু অনেক কিছুরই সূচনা করেছিলেন। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গঠনে নিয়েছিলেন সময়উপযোগী নানা উদ্যোগ। তিনি তার কাজের মাধ্যমে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। মানুষের জন্য একটি রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন। সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। অনিয়ম দুর্নীতির অচলায়ন ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক বিভেদ-বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। স্বল্প সময়ে তিনি যে স্বপ্নের সিঁড়ির ভিত্তি গড়েছিলেন এতোদিনে তা কতোদূর পৌঁছেছে এটিই এখন মূল্যায়নের বড় বিষয়।
দীর্ঘ সংগ্রাম আর পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু জাতিকে মুক্তির মোহনায় একত্রিত করতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার আকাঙ্খা জাগিয়ে তুলেছিলেন প্রাণে প্রাণে। অবিসংবাদিত এ নেতার ডাকে তাই মরণপণ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতাকামী মানুষ। পাকিস্তানের কারাগারে থাকা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ ধীরে ধীরে ধাবিত হয়েছে চূড়ান্ত পর্বে। নয় মাসের সংগ্রাম শেষে উদিত হয় স্বাধীনতার লাল সূর্য। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু দেশগড়ার যে কাজ শুরু করেছিলেন তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের কালো রাতে বিভৎস হত্যাকাণ্ডে থমকে যায় জনকের স্বপ্নযাত্রা। বঙ্গবন্ধুকে সেদিন স্বপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা পৃথিবীর নৃশংসতম ঘটনার অবতারণা করে। কিন্তু তারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় তা সফল হয়নি। মাঝে কিছু ব্যত্যয় হলেও বঙ্গবন্ধু’র দেখানো পথ ধরেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু সময় এবং সীমানা পেরিয়ে পরিণত হয়েছেন মহাকালের মহান নেতায়। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে দেয়া তার ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ভাষণের একটি। জন্মশতবর্ষে এই মহান নেতা নতুন মহিমায় উদ্ভাসিত হবেন জাতীয় জীবনে। মুজিব বর্ষের নানা কর্মসূচিতে তাকে স্মরণ করবেন বিশ্বনেতারা।
আজ থেকেই শুরু হবে মুজিব বর্ষের ক্ষণ গণনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয়ভাবে বিকালে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে মুজিব বর্ষের কাউন্টডাউন অনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এরপর প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও সকল পাবলিক প্লেসে একইসঙ্গে কাউন্টডাউন শুরু হবে। সারা দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের ২৮টি পয়েন্টে, বিভাগীয় শহরগুলো, ৫৩ জেলা ও দুই উপজেলা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীতে মোট ৮৩টি পয়েন্টে কাউন্টডাউন ঘড়ি বসানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে একটি বাস্তবায়ন কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতাসহ রাজনীতিক ও বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনরা। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে জাতীয় কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়া জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে বাস্তবায়ন কমিটি।
জাতির পিতার শততম জন্মবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে সরকারের পাশাপাশি দলীয়ভাবেও কর্মসূচি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আতশবাজির মাধ্যমে শুরু হবে মুজিব বর্ষের ক্ষণ গণনা। এছাড়া দেশ-বিদেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র, প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, বঙ্গবন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন, ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড’ এবং হাতে হাত রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি গড়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণ। এছাড়া কনসার্টসহ নানা আনন্দ আয়োজন ও রক্তদানসহ সেবাধর্মী কর্মসূচি থাকবে বছরজুড়ে। ১৭ই মার্চ মূল অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং বঙ্গবন্ধুর সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যক্তিত্বকে। তাদের মধ্যে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ, ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ বিশ্বনেতারা।
জন্মশতবার্ষিকীর মূল আয়োজন শুরু হবে ১৭ই মার্চ সূর্যোদয়ের সময়ই। সকালে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান। এদিন ঢাকা ও গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় একই সঙ্গে অনুষ্ঠান শুরু হবে। সকালে টুঙ্গিপাড়ায় থাকবে জাতীয় শিশু দিবসের নানান আয়োজন। এরপর বিকালে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে মূল অনুষ্ঠান। প্রকাশ করা হবে জন্মশতবার্ষিকীর বিভিন্ন স্যুভেনির, স্মারক বক্তৃতা, দেশি-বিদেশি শিল্পীদের সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সারা দেশেই এদিন আয়োজন করা হবে আনন্দ র্যালি। সাজানো হবে গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা, সড়কদ্বীপ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৭ই মার্চের মূল আয়োজনে থাকবেন বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান, বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যক্তিত্বরা।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আজ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের এদিন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে জাতির এই অবিসংবাদিত নেতা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি পাকিস্তান থেকে প্রথমে লন্ডন যান। তারপর দিল্লী হয়ে ঢাকায় ফেরেন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে আটক রাখা হয়। স্বাধীনতাকামী এই নেতাকে কারাগারে তাকে হত্যার ভয় দেখানো হয়। কিন্তু তিনি কিছুতেই দমে যাননি। আপসহীন এ নেতা অটল ছিলেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রতিজ্ঞায়।
১৯৭২ সালের ৭ই জানুয়ারি ভোর রাতে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করে বিমানে পাঠিয়ে দেয়া হল লন্ডনে। তখন তার সঙ্গে ড. কামাল হোসেনও ছিলেন। সকাল সাড়ে ৬টায় তারা পৌঁছান লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে। বেলা ১০টার পর থেকে তিনি কথা বলেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকের সঙ্গে। ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে পরের দিন ৯ই জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন বঙ্গবন্ধু। ১০ই জানুয়ারি দিল্লিতে অবতরণ করে ওই বিমান। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পুরো মন্ত্রিসভা, রাজনৈতিক দলের নেতারা রাজকীয় অভ্যর্থনা জানান বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু ঢাকা এসে পৌঁছেন ১০ই জানুয়ারি দুপুরের পর। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানাতে অধির অপেক্ষায় ছিল। আনন্দে আত্মহারা লাখ লাখ মানুষ ঢাকা বিমান বন্দর থেকে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত তাকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জানায়। লাখো মানুষের ভিড় ঠেলে বঙ্গবন্ধুকে বহন করা গাড়ি বহর উদ্যানে পৌঁছতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। বিকাল পাঁচটায় রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তিনি ভাষণ দেন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ধ্রুপদি ভাষণে বলেন, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যা দিয়েছিলেন অন্ধকার থেকে আলোপথে যাত্রা হিসেবে।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারাদেশে সংগঠনের সকল কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭ টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে প্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন। এছাড়া জন্মশতবর্ষ পালনের ক্ষণ গণনা কর্মসূচিতেও অংশ নেবেন দলের নেতারা।