ঢাকা: আগামী ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সাংগঠনিক শক্তি দেখাতে মরিয়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। ‘গণতন্ত্রের বিজয়ের দিন’ আখ্যা দিয়ে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের এই দিনে উৎসবের শোডাউন করার সব প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ। অন্য দিকে বিএনপি এ দিনটিকে ঘোষণা করেছে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে। দলটির পরিকল্পনা অনুযায়ী ওই দিন ঢাকায় যেকোনো মূল্যে সমাবেশ হবে। যে সমাবেশ ঘিরে রাজপথে নামানো হবে জনতার স্রোত। বিএনপির কাছে ৫ জানুয়ারি নতুন নির্বাচনের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার দিন হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
দুই দলের এমন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, সমঝোতার পথে না গেলে অনিবার্য সঙ্ঘাতের দিকেই এগোবে রাজনীতি।
বিগত বছরের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘বিতর্কিত’ দশম সংসদ নির্বাচন। তখনকার প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সক্রিয় বহু রাজনৈতিক দল ওই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে লাগাতার হরতাল-অবরোধের পথ বেছে নিয়েছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল। নির্বাচনের দিন সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ভোটার উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা। ওই নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেরও প্রশ্ন রয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলেছেন, বিগত বছরের ৫ জনুয়ারি ‘গণতন্ত্রের কবর’ রচনা করা হয়েছিল। গত এক বছর সরকারকে তারা নতুন নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সরকার তাতে কোনো কর্ণপাত করেনি। এ কারণে আগামী ৫ জানুয়ারিকেই চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার দিন হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে।
গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে ৫ জানুয়ারি ঘিরে দলের পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের লক্ষ্যে ওই দিন সারা দেশে সভা-সমাবেশ ও কালো পতাকা বিক্ষোভ মিছিল হবে। এ উপলক্ষে ঢাকায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হবে।
জানা গেছে, ৫ জানুয়ারির কর্মসূচি সফল করার বিষয়টি বিএনপি নিয়েছে বাঁচা-মরার লড়াই হিসেবে। যেকোনো মূল্যে এ দিন ঢাকায় সমাবেশ করে শোডাউন করবে বিএনপি। জনসভা জনসমুদ্রে রূপ দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে ব্যাপকভাবে। ইতোমধ্যে দলের প্রতিটি স্তরে সমাবেশের দিন সঙ্ঘবদ্ধভাবে মাঠে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রাজধানী ছাড়াও নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোকে জনসভায় যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ঘিরে কোনো হামলা হলে, তা প্রতিরোধ করতেও বলা হয়েছে।
জানা গেছে, ৫ জানুয়ারি ঘিরে দু’টি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। প্রথমত, যেকোনো মূল্যে সমাবেশ করা। দ্বিতীয়ত, সমাবেশ করতে দেয়া না হলে টানা হরতাল ডাকা, যাতে করে আওয়ামী লীগ ওই দিন কোনো সমাবেশ করতে না পারে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, রাজপথের আন্দোলন থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ বিএনপির নেই। যেকোনো উপায়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। রাজধানী ঢাকাকে আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করাই বিএনপি জোটের এবারের টার্গেট বলে তিনি জানান।
খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, বেগম জিয়া কঠোর আন্দোলনে নামতে অনমনীয় অবস্থানে রয়েছেন। ৫ জানুয়ারি বাদ দিয়ে আরেকটু সময় নিয়ে আন্দোলনে নামার সব প্ল্যান তিনি ইতোমধ্যে উড়িয়ে দিয়েছেন।
দলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, ৫ জানুয়ারি মাঠে নামতে না পারলে বিএনপির সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। পরিকল্পিত আন্দোলনের জন্য তারা হাইকমান্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন।
এ দিকে বিএনপির আন্দোলনকে পাত্তা না দিলেও ৫ জানুয়ারি নিয়ে সরকার কিছুটা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ৫ জানুয়ারিতে সরকারবিরোধীরা যাতে বড় ধরনের কোনো আন্দোলন বা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে যেমনি প্রস্তুত হচ্ছে, তেমনি প্রশাসনকেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ওই দিন আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে রাজপথ নিজেদের দখলে রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
গত ১২ ডিসেম্বর ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ আখ্যা দিয়ে বিজয় উৎসব করার ঘোষণা দেয়া হয়। জানানো হয়, এ দিন ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশের জেলা, উপজেলা, থানা ও পৌরসভায় একযোগে শোভাযাত্রা ও আনন্দ র্যালি বের করবে তারা। এখন পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে কিছু বলা না হলেও বিএনপিকে ওই দিন ঢাকায় সমাবেশ করতে না দেয়ার পক্ষপাতী সরকার।
গতকাল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ঢাকাসহ সারা দেশে বিজয় র্যালি করবে। আর ওই দিন বিকেলে ঢাকার ১৬টি স্পটে গণতন্ত্রের বিজয়ে সমাবেশ হবে। এতে কেন্দ্রীয় নেতারা পৃথক পৃথকভাবে অংশ নেবেন।
তিনি বলেন, হুমকি-ধামকি দিলেও ৫ জানুয়ারি বিএনপির ‘কাগুজে বাঘদের’ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
জানা গেছে, ৫ জানুয়ারি রাজনীতির মাঠ দখলে রাখার ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা এ বিষয়ে সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সাথে ইতোমধ্যে বৈঠক করেছেন। ঢাকায় দলীয় এমপিদেরও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ৫ জানুয়ারি দলীয় কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সম্ভাব্য ‘নাশকতামূলক’ কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো ‘উসকানিমূলক’ তৎপরতা থাকলে তা সাথে সাথে প্রতিহত করতে বলা হয়েছে।
সূত্র মতে, শুধু ৫ জানুয়ারিই নয়, আগামী দুই মাস দেশজুড়ে সিরিজ সভা-সমাবেশ ও মিছিল করবে আওয়ামী লীগ। এরিমধ্যে বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৪ দল জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ১০ জানুয়ারির জনসভাকে জনসমুদ্রে রূপ দেয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।