ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা: বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক নিপীড়ন, বিরোধী দল দমন এবং বীভৎস দুর্নীতিকে সরিয়ে রাখলে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, তা হলো ‘নির্বাচন’। ২০১৪ সাল থেকে সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বাচন ব্যবস্থাকে এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যে, জাতীয় বা স্থানীয় কোনো নির্বাচনেই মানুষের ভোটের আর কোনো প্রয়োজন হচ্ছে না।
২০১৪ সালে অতিবিতর্কিত একতরফা একটি তথাকথিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত হওয়ার পর সকলেই ধারণা করেছিল এর মেয়াদ ৫ বছর দূরে থাকুক, কয়েক মাসও সম্ভবত হবে না। এমনকি সরকারের তরফ থেকে এমনও বলা হয়েছিল যে এটি একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, অচিরেই সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সম্ভবত সে সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি যে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দলীয় ক্যাডার, প্রভাবশালী বিদেশি বন্ধুদের সহায়তায় জনগণকে তুচ্ছ করে ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করা যায়। সবারই নিশ্চয়ই স্মরণে আছে- সে সময়ে কীভাবে নানা নাটক করে জবরদস্তিমূলক বিরোধী দল গঠন করা হয়েছিল। যা অদ্যাবধি গৃহপালিত বিরোধী দল নামেই বেশি পরিচিত। তামাম বিশ্বেই ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ এক নতুন কনসেপ্ট।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরে সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও একচেটিয়া একদলীয় ভোটারবিহীন নির্বাচনে রূপ নেয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্ধারিত একাদশ সংসদ নির্বাচনটি যে কোনোভাবেই এর ব্যতিক্রম হবে না, তা যেকোনো বিবেচনাতেই বোঝা উচিত ছিল। এই ‘নির্বাচন’ যদি কাউকে বিস্মিত করে থাকে তাহলে সেটা তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দৈন্যতা। দশম সংসদ নির্বাচনের পরে যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা হয়েছে তেমনি একাদশ সংসদ নির্বাচনের পরেও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার স্বয়ং, গবেষণা সংস্থা টিআইবি, বিদেশি গণমাধ্যম, বিদেশি পর্যবেক্ষক, সুজন প্রত্যেকেই নির্বাচনটির কঠোর সমালোচনা করেছে। এই নির্বাচন নিয়ে ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি প্রধান রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমি সাক্ষী দিয়ে বলছি, এই নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু জনগণ ভোট দিতে পারেনি।’ যেই নির্বাচনে তথাকথিত নির্বাচিতরাই প্রকাশ্যে উচ্চকণ্ঠে স্পষ্ট বলেন, মানুষ ভোট দিতে পারেননি সেটা আর যাই হোক কোনোভাবেই নির্বাচনের সংজ্ঞায় পড়ে না।
অতি সম্প্রতি ঘোষিত হলো ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ। নির্বাচন নিয়ে মানুষের উৎসাহ বা প্রত্যাশা তেমন না থাকলেও দলগুলো ইতিমধ্যেই তাদের প্রার্থী মনোনয়নের ইঙ্গিত দিয়েছে।
এই দেশের মানুষ এখন স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটকেন্দ্র বিমুখ। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করছি সংসদে দাঁড়িয়ে রাশেদ খান মেননের উক্তি- ‘আজান দিয়েও আজকাল ভোটার আনা যায় না’। তাই খুব সম্ভব ভোটকেন্দ্র বিমুখ মানুষকে কেন্দ্রে আনার জন্যই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করলেন ‘আমি আশ্বস্ত করছি, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে’। নির্বাচন সুষ্ঠু করা নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং নির্বাচন পরিচালনার সকল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের একক। এই বিষয়ে সরকারের একজন মন্ত্রী এবং সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক কী করে আশ্বস্ত করেন তা আমার বুঝে আসে না। ভোট সুষ্ঠু করবার দায়িত্ব যখন তিনি নিচ্ছেন তার অর্থ কি এই নয় যে, এতদিন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন দলীয় ক্যাডার এবং প্রশাসনই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের একমাত্র বাধা ছিল। তিনি তার বক্তৃতায় আরো বলেন, ‘আমি আশ্বস্ত করছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসিকে সবধরনের সহায়তা করবে সরকার। আপনারা নির্বাচনে আসুন, ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হবে।’ অথচ বিষয়টি সরকারের জন্য ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয়, এটা বাধ্যবাধকতা। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে’ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশের বিষয়ে আশ্বস্ত করতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, ‘সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। ভোট নিয়ে ভয়ের কারণ নেই’। ‘সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না’ কথাটির মাঝেই লুকিয়ে আছে যে সত্য তা হলো মানুষ এটা জানে যে সরকার নির্বাচনে যাচ্ছেতাইভাবে হস্তক্ষেপ করে।
পরবর্তীতে অবশ্য সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের নির্বাচনে হাত না দেয়া সংক্রান্ত উদারতার কারণ তিনি নিজেই স্পষ্ট করেছেন এই বলে যে- ‘সিটি ভোটে হেরে গেলে সরকারের ওপর আকাশ ভেঙে পড়বে না’। এর সরল বাংলা করলে দাঁড়ায় জাতীয় নির্বাচনে হেরে গেলে যেহেতু মাথায় আকাশ ভাঙার বিষয় থাকে, তাই সেখানে যেনতেনভাবে নির্বাচনে জেতা যেতেই পারে। আর হারলে আকাশ ভেঙে পড়বে না এমন দুই একটি নির্বাচন সুষ্ঠু হতে দিয়ে সরকারি দল হেরে গেলেও দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে এমন কথা বলা যাবে বৈকি বুক ফুলিয়ে।
গত ২৫শে ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘কেন নির্বাচন নিরপেক্ষ, শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হয় না এ প্রশ্নের উত্তর আত্মজিজ্ঞাসার কারণে আমাকে খুঁজতে হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন আইনত স্বাধীন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাছে বন্দি’। বর্তমানে নির্বাচন প্রক্রিয়া যে সরকারের একেবারে কব্জায় আছে যে কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও একটি নিরপেক্ষ, শুদ্ধ, ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে একটি কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সেটি জনাব তালুকদারের এই বক্তব্যে খুব স্পষ্ট। এমনকি নির্বাচন কমিশন চাইলেও নির্বাচন আদৌ অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য হবে কিনা সেটার জন্য কমিশনকে সরকারের ইচ্ছে-অনিচ্ছের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। অবশ্য জনাব তালুকদার ছাড়া সিইসিসহ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সকল সদস্য সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছেন, তাই নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য কমিশনকে সরকারের সঙ্গে কোনোরকম লড়াইয়ে নামতে হয়নি।
সেই সভায় জনাব তালুকদার আরো বলেন, ‘নির্বাচন যদি গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের পদযাত্রা অবারিত করতে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হতে হবে’। বরিশাল, গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসন্ন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিগত ওই তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না’। কিন্তু কাগজে-কলমে স্বাধীন থাকা নির্বাচন কমিশন যতই ভালো নির্বাচন প্রত্যাশা করুক না কেন, সরকার না চাইলে আমাদের মতো দেশে যে নির্বাচন কোনোক্রমেই সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয় তা একজন শিশুও বোঝে। যে কারণে জনাব তালুকদার বারবারই নির্বাচন প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন।
মাহবুব তালুকদার খুব গুরুত্বপূর্ণ আর একটি কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘অবৈধভাবে নির্বাচিতদের জনগণের প্রতি বা গণতন্ত্রের প্রতি কোন কমিটমেন্ট থাকে না’। কথাগুলো নতুন নয়, কিন্তু তথাকথিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিকে সামনে রেখে একজন নির্বাচন কমিশনারের এই বক্তব্য আলাদা গুরুত্ব রাখে তো বটেই। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে জনগণের প্রতি কমিটমেন্ট না থাকা সরকার কেমন হতে পারে। এ ধরনের একটি রেজিমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ কোনো একক ব্যক্তি বা দলের পক্ষে সম্ভব নয়, একমাত্র জাতীয় ঐক্যই পারে এর থেকে আমাদের মুক্ত করতে।