জীবদ্দশাতেই তার অনেক স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন দেখে গেছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ওই স্বপ্নদ্রষ্টার সমস্ত চিন্তা ছিল হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক, মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং বৃহত্তর অর্থে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা দরিদ্র মানুষদের নিয়ে। বৈশ্বিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচনে অবদানের জন্য ২০০৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর বৃটেনের রানী প্রদত্ত সবচেয়ে বড় সম্মাননা নাইটহুড অর্জন করেন তিনি। তার সেই অর্জনের ঘোষণার পরদিন মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ‘আরো অনেক কাজ বাকি’ দাবি করে তিনি বলেছিলেন- ২০১০ সাল হবে তার কাজের বছর। ওই বছরে তিনি তার স্বপ্নের ব্র্যাককে ভেতর থেকে শক্তিশালী করে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ গ্রহণের উপযোগী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিবেন। নাইট প্রাপ্তির পর অসম্পূর্ণ কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার তাগিদ যেনো তাকে আরও প্রবলভাবে পেয়ে বসেছিল। ব্যক্তি আবেদ এবং বাংলাদেশের জন্য বিরল ওই সম্মান অর্জনের পর স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে তিনি বলছিলেন- ‘আমি আর ব্র্যাক একাকার হয়ে গেছি। ব্র্যাক ছাড়া এখন আর কিছু চিন্তা করতে পারি না।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমার তো বয়স হয়েছে।
ইচ্ছা থাকলেও এখন আর অনেক কিছুতে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারি না। আগামীতে হয়ত সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারবো না। এখন আমার প্রধান কাজ হচ্ছে ব্র্যাকে আমার উত্তরসূরি তৈরি করা। আর এ কাজটি দ্রুত শুরু করতে হবে।’ ব্যক্তিগতভাবে নিজের স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ব্র্যাকের পথচলা, নতুন বছরে দেশের উন্নতি অগ্রগতি তথা বিশ্বের দারিদ্রপীড়িত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং ক্ষমতায়নের সংগ্রাম ও সফলতার আকাঙ্খার কথা সেদিন যেনো আরও জোরেশোরে বলছিলেন তিনি। ১০ বছর আগের সেই সাক্ষাৎকারে তাঁর চাহনিতে প্রাপ্তির আনন্দ যেমন ছিল, তেমনি আরও অনেক কিছু অর্জনের আকাঙ্খাও তাকে তাড়া করছিলো। তার ভাষ্যটি ছিল এমন- ‘আগামীর দিনগুলোতে আমাদের আরও অনেক সুখবর আসবে এটা আমি নিশ্চিত। ২০১০ হবে প্রবৃদ্ধি আর সমৃদ্ধির বছর।
কৃষিতে ব্যাপক সম্ভাবনা ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে, এখন বিপ্লব হবে। বিনিয়োগ বাড়বে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ায় অনেক ক্ষেত্রেই আমরা প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারবো। ব্যাংকিং সেক্টরে অনেক উন্নতি হয়েছে। আশা করি এখন আমাদের মোবাইলে লেনদেনের সূযোগ সৃষ্টি হবে। সেবার মানও বাড়বে। অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। উন্নতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে আগামী দশকে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত হবে।’ স্যার আবেদের বিদায়ের ঘোষণা আসার অল্প ক’দিন আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তরফে যেসব রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে তাতে উল্লেখিত ক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশের অভাবণীয় উন্নতির চিত্র ফুটে ওঠেছে। সরকারী তথ্য মতে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কেবল বাড়েনি, এটি এখন নিয়মিতভাবে ৮-এর ঘরে আছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যাদের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা রয়েছে। এখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। মোবাইলে ব্যাংকিং লেনদেন হচ্ছে আরও ক’বছর আগে থেকে। ১০ বছর আগে ব্র্যাক ৮টি দেশে কাজ করতো। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ফজলে হাসান আবেদ আরও দু’টি দেশ নাইজেরিয়া এবং হাইতির হতদরিদ্র মানুষদের জীবন মান উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন। সেই সময়ে দেশ দু’টিতে ‘মিশন ব্র্যাক’ চালুর বিষয়টি ছিল পরিকল্পনা পর্যায়ে। আবেদের ভাষায়- ‘হাইতি ও নাইজেরিয়ার দরিদ্রপীড়িত মানুষদের মাঝে বহুমাত্রিক কর্মসূচি নিয়ে হাজির হতে চায় ব্র্যাক।’
সত্যিই এখন ব্র্যাক দেশ দু’টিতে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বহুমুখি কর্মসূচি নিয়ে দরিদ্র মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে। কেবল হাইতি বা নাইজেরিয়াই নয়, এখন বিশ্বের ১১টি দেশে ব্র্যাক মিশন রয়েছে। তার মৃত্যুতে ওই সব দেশেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তারাও কীর্তিমান আবেদের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনকে বিভিন্ন পন্থায় স্মরণ করছেন। আবেদের এ বিদায় তাদের জন্যও ক্ষতির- এমনটাই বলছেন ঢাকায় নিযুক্ত বৃটিশ হাই কমিশনার রাবার্ট চ্যাটার্সন ডিকসন। তাৎক্ষণিক টুইট বার্তায় বৃটিশ দূতের ভাষ্যটি ছিল এমন ‘শুনে খুবই খারাপ লাগছে যে ফজলে হাসান আবেদ আর আমাদের মাঝে নেই। তার এ বিদায় ব্র্যাকের জন্য বড় ক্ষতি তো বটেই, এটা বাংলাদেশ এবং সেই সব দেশেরও ক্ষতি যেসব দেশে তিনি গরিব মানুষদের জীবনে পরিবর্তন আনতে কাজ করেছেন। তার আইডিয়া এবং পরিশ্রমে গড়া কীর্তি (ব্র্যাক) আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও মর্যাদাপূর্ণ এনজিওতে পরিণত হয়েছে।’ ঢাকাস্থ জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পোর মতে, ‘সাফল্যমণ্ডিত জীবন আর রেখে যাওয়া দর্শনে আবেদ ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি বিশ্বে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। তার প্রচেষ্টাগুলোর কথা কখনই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।’ ব্র্যাককে ভেতর থেকে শক্তিশালীকরণে জোর ছিল আবেদের।
যেনো তার অবর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনায় কোন ব্যত্যয় না ঘটে। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলছিলেন- ‘আমি এমন উত্তরসূরি চাই, যারা আমার দায়িত্বগুলো বুঝে নেবেন। সংগঠন পরিচালনা এবং কাজের গতি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পরিচালকও নিয়োগ দেয়া হবে।’ ব্র্যাকের পরিচালনা পর্ষদে সংযোজন এবং পরিবর্তন এসেছে। ব্র্যাক গ্লোবালের চেয়ারে জাতিসংঘে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আমিরা হককে নিয়ে আসা হয়েছে। এ সবই হয়েছে স্যার আবেদের জীবদ্দশায়। জগতে কেউ চিরস্থায়ী হয়, স্যার আবেদও বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তিনি যেমনটা চেয়েছিলেন ১০ বছর আগে, তার অবর্তমানে ব্র্যাক যেনো হোঁচট না খায়! নতুন দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিশ্চয়ই তা হতে দেবেন না। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ১লা জানুয়ারি (শুক্রবার) নাইটহুট অর্জনের পরদিন গুলশানের বাসায় আপ্লুত ফজলে হাসান আবেদ মানবজমিনকে ১৭ মিনিটের একান্ত সাক্ষারকার দিয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আবেদ তনয়া তামারা হাসান আবেদ। তিনি তখন আড়ং এবং ব্র্যাক ডেইরির পরিচালক। স্মরণ করা যায়, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূস ২০০৬ সালের অক্টোবরে যখন নোবেল পেলেন ফজলে হাসান আবেদ তখন দেশের বাইরে। বিদেশ থেকে ক্ষুদে বার্তায় তিনি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
তিনি দেশে ফেরার পরপরই মানবজমিনকে ২৩ মিনিটের একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। মহাখালিস্থ ব্র্যাক ইনের ওই সাক্ষাৎকারে দেশের দরিদ্র মানুষের মুক্তির পথ ও পন্থা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছিলেন তিনি। পিছিয়ে পড়া মানুষদের জীবনমান এগিয়ে নেয়ার ওই আন্দোলনে ব্র্যাক ও গ্রামীণ কিভাবে একে অন্যের পরিপূরক হিসাবে কাজ করতে পারে সে কথাই বলছিলেন তিনি। আবেদ ‘ভাই’র নাইটহুট অর্জনের খবরে ব্র্যাক সেন্টারে ছুটে যান সুহৃদ ড. ইউনূস। সেদিন প্রায় ৩০-৩৫ মিনিট তারা একান্তে কথা বলেন। পরবর্তীতে মানবজমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে দুই বড় এনজিও ব্যক্তিত্বের মধ্যে কী কথা হয়েছিল? এমন প্রশ্নও ছিল। ওই প্রতিবেদককে আবেদ বলছিলেন- মানবতার কল্যাণ ও মুক্তিই আমাদের দু’জনের অভিন্ন লক্ষ্য। স্বভাবতই এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে।