ঢামেকের পুরাতন বিল্ডিংয়ের তিন তলার ৩৬ নম্বর কেবিন। কক্ষের সামনে শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকদের জটলা। ভেতরে প্রবেশ
করতেই দেখা যায় নুরসহ আহত চারজনকে ওই রুমে রাখা হয়েছে। চিকিৎসা নিচ্ছেন ভিপি নুরসহ ছাত্র সংগঠনের আহত নেতারা। আইসিইউতে ৯ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন গুরুত্বর আহত তুহিন ফারাবি। দুপুর সাড়ে ১২টায় তাদের স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নিতে আসেন ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন। লাইফ সাপোর্টে থাকা গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত যুগ্ম আহ্বায়ক তুহিন ফারাবির ভাগ্নে মোহন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে একটি ভূঁইফোর সংগঠনের নেতৃত্বে তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালানো হয়। ঘটনার দিন এর আগের হামলার জেরে নুরের আঙ্গুলে যে আঘাত পেয়েছে সেটার ফলোআপ দেখে ডাক্তার ডাকসুর কক্ষে যান।
ক্যাম্পাসে প্রবেশের সময় তারা কোনো প্রকার শো ডাউন কিংবা স্লোগান দেয় নি। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন। কিছুক্ষণ পরে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নেতৃত্বে একটি মিছিল আসে। এসময় তাদেরকে এ্যভয়েড করে একপাশে চলে আসে ফারাবিরা। তারা মিছিল নিয়ে মধুর ক্যান্টিনে প্রবেশ করে। এরপর হঠাৎ করে পেছন দিক থেকে কিছু লোক স্টিলের পাইপ, লোহার রডসহ লাঠিসোটা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় ফারাবী ছিলো নুরের একদম পাশে। ফলে পেছনে যারা ছিল তারা বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এর আগে ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত দাস নুরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। তখন নুরকে বলা হয়, আপনি কেন বহিরাগত লোকজন ডাকসুতে নিয়ে এসেছেন। এসময় নুর বলেন, ‘আত্মরক্ষার্থে আমি তাদেরকে সঙ্গে এনেছি। আমার সহযোদ্ধারা আমার পাশে থাকবে। এটাতো অন্যায় কিছু না।’ তারা দুজন বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদল ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা ভেতরে প্রবেশ করে রুমের দরজা-জানালা, লাইট-ফ্যান বন্ধ করে দেয়। এসময় লোহার পাইপ দিয়ে এলোপাথারি পেটাতে থাকে। ঢাকা কলেজের ছাত্র নাজমুল হাসান ও নুরকে যখন মারতে আসে তখন ফারাবি তাদেরকে মাটিতে ফেলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখে। ফারাবির পিঠের ওপর সব আঘাতগুলো পরে। ধারালো কিছুর আঘাতে ফারাবির ডান হাতের তালু পুরোটা কেটে যায়। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এসময় ফারাবি ভেবে নেয় যে নুর মরে গেছে। নিজের জীবন বাজি রেখে নুরকে রক্ষা করেছে ফারাবি।
ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ঘটনার দিন ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলাম। এর আগে গত ১৭ই ডিসেম্বরের হামলায় আমার আঙ্গুল ভেঙেছিলো তার ফলোআপ করার জন্য। এ সময় আমার সঙ্গে সংগঠনের ২০ থেকে ২৫ জন নেতা-কর্মী ছিলো। ডাক্তার দেখিয়ে আমরা ডাকসু রুমে সবেমাত্র প্রবেশ করি। এর মধ্যে কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ এবং মধুর ক্যান্টিনে থাকা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রড, বাঁশ, লাঠিসোটা নিয়ে আমাদের উপর হামলা করে। এরপর ওরা চলে যায়। পরবর্তীতে আমরা রুমে বসি। এসময় ওরা বাইরে থেকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করছে। ডাকসুর কর্মচারিদের ডেকে কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দিতে বলা হয়। সঙ্গে থাকা অন্যদের আমি বলেছি সবাই যেন শান্ত হয়ে বসে থাকে। এসময় ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত, গেটের কলাপসিবল খুলে তাদের নেতা-কর্মীদের নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। রুমে ঢুকেই তারা আমার সঙ্গে থাকা ছেলেদের মারতে শুরু করে। তিনজনকে মেরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। এসময় সনজিত আমাকে ধাক্কা দেয়। আমি সনজিতকে বলি, আপনি ডাকসুর কে? যে এভাবে আমাদের চার্জ করছেন ? তখন সনজিত বলেন, আমি কে একটু পরেই টের পাবি। সাদ্দাম ও সনজিত বের হয়ে যাওয়ার পরে হামলাকারীরা লাইট বন্ধ করে বাঁশ, রড নিয়ে আতর্কিত হামলা করে। আমার সহকর্মীরা আমাকে চেয়ার-টেবিলের নিচে ঢেকে রাখে। ক্ষোভটা আমাদের ওপর বেশি ছিল ওদের। আমার মুখবন্ধ রাখার চেষ্টা এর আগেও অনেকবার করা হয়েছে। তবে এইবার কিন্তু আমাকে হত্যা চেষ্টা করেছে। প্রাণে মেরে ফেলতে চেয়েছে একেবারে। আমার শরীরের ডান পাশ অচল করে দিয়েছে। এখন দেশের মানুষের প্রতি, সচেতন মানুষের প্রতি আহ্বান জানাই, সবাই যেন ঐক্যবদ্ধভাবে এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অন্যথায় স্বাধীনতার সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে। এই ঘটনাগুলোর যদি দেশবাসী প্রতিবাদ না করে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে না দাড়ায় তাহলে আর কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পাবে না। মনে রাখতে হবে, ডাকসু কোনো ব্যক্তির না, এটা একটা প্রতিষ্ঠান। ডাকসুতে ঢুকে ছাত্রলীগ যেভাবে প্রকাশ্যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে তা পাকিস্তানি হানাদারদেরও হার মানিয়েছে।
সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক এ পি এম সুহেলকে ডাকসু ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে। সুহেল বলেন, পিটানোর এক পর্যায়ে আমাকে কখন ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেয় কিছুই মনে পরছে না। এ বিষয়ে আমার সহযোদ্ধারা ভালো বলতে পারবেন। সুহেলের মা জমিলা বেগম বলেন, আমিনুল, বুলবুল এরা তাকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়। তার মাথায়, পিঠে ও বাম চোখে গুরুতর আঘাত পেয়েছে। তাকে এমনভাবে ফেলে দেয়া হয় যে, প্রথমে একটি ছাদের উপর পড়ে। সেখান থেকে আরেকটি ছাদের উপর গিয়ে পড়ে। এর আগেও একবার আমার ছেলেকে মেরেছে। বিনা অপরাধে জেল খেটেছে। আমাদের ছেলেরা কোনো অন্যায় তো করেনি। তাদের উপর একের পর এক হামলা করা হচ্ছে। যার কোনো বিচার হচ্ছে না।
সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেন বলেন, আমরা নিয়মিত ডাকসু অফিসে বসি। ঘটনার দিনও অফিসে বসে ছিলাম। এসময় ছাত্রলীগের ছেলেরা কোনো একটি অনুষ্ঠান শেষ করে মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন ভেতরে ঢুকে আমাদের উপর হামলা চালায়। এসময় আমাদের সঙ্গে থাকা ছেলেরা প্রতিহত করার চেষ্টা করে। তখন তারা নিচে নেমে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে তারা আরো লোকজন নিয়ে জড়ো হয়। সবতো ছাত্রলীগের ক্যাডার। বাহির থেকে এলোপাথারি ইট পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা অতিবাহিত হয়। এরপর আসে সাদ্দাম ও সনজিত। তারা ভিপির রুমে এসে খুব বাজেভাবে গালি দিতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পর ছাত্রলীগের আরো নেতারা ভেতরে প্রবেশ করে আমাদের সঙ্গে থাকা ছেলেদের মারতে শুরু করে। এসময় সনজিত আমাদের বলে, তোরা দুই মিনিটের মধ্যে এখান থেকে বেড়িয়ে যা। না হলে খুব খারাপ হবে। এর এক মিনিটের মাথায় তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা রুমে প্রবেশ করে লাইট ফ্যান বন্ধ করে দেয়। অন্ধকারে তারা এলোমেলো পিটাতে থাকে। এসময় আমি আমরা মাথা সেভ করার চেষ্টা করি। তারপরেও আমার মাথায় এবং কানে একাধীক রডের আঘাত লাগে। কান দিয়ে অনবরত রক্ত ক্ষরণ হয়।