আমি তৃপ্ত যে আমার জীবন বৃথা যায়নি। আমি একদিন থাকবো না কিন্তু ব্র্যাক থেকে যাবে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের চাহিদা পূরণে কাজ করে যেতে হবে ব্র্যাককে। রবীন্দ্রনাথ আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। এ কারণে জীবনের শুরুতে আমি কবি হতে চেয়েছিলাম। -কথাগুলো প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদের। ব্র্যাকের অফিসিয়াল ইউটিউবে প্রকাশিত এক প্রামাণ্যচিত্রে তিনি এসব কথা বলেন। আট মিনিটের ওই প্রামাণ্যচিত্রে স্যার আবেদ তার জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন।
ওই প্রামাণ্যচিত্রে স্যার আবেদের বক্তব্য হুবহু নিচে তুলে দেয়া হল: রবীন্দ্রনাথ আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। একজন গৃহবধূর জীবনের সুখ দুঃখকে একান্তই তার অনুভূতির জায়গা থেকে যেভাবে তিনি রুপায়িত করেছেন, তা অনন্য। জীবনের শুরুতে আমি একজন কবি হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কবিতা লেখার হাত খুব একটা ভালো ছিল না। পরে আমি সিদ্ধান্ত নেই আমি অন্য কিছু হবার চেষ্টা করি। আমি, তরুণ বয়সে নেভাল আর্কিটেকচারে পড়তে যাই গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে। কিছুদিন পর ঠিক করলাম এই বিষয়টিতে আর পড়ব না। আমি ভাবলাম এই বিষয়ে পড়ে দেশে ফিরে আমি কোন চাকরি পাব না। পরে সিদ্ধান্ত নেই অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়বো। ঠিক এই সময়টাতে আমি ইউরোপীয় সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য এমনকি স্থাপত্য বিষয়েও আগ্রহী হয়ে উঠি। ধীরে ধীরে আমি ইউরোপীয় শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে উঠলাম।
বিদেশে থাকাকালীন ১৯৫৭ সালে আমি আমার মাকে হারাই। মায়ের মৃত্যুর কারণেই আমি পড়ালেখা শেষ করার পর দেশে ফিরিনি। মাকে হারানো আমার জন্য ছিল এক বিরাট ক্ষতি। মা ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। আমি এখন ভাবি, কত অল্প বয়সেই আমার মা মারা গেলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৪৪ বছর। ১৯৬৫ সালে আমি দেশে ফিরে আসি। দেশে এসে যা দেখলাম তা আমার মন ছুঁয়ে গেল। ১৯৬৮ সালে আমি একেবারে দেশে চলে আসি।
১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় নিয়ে তিনি বলেন, আমি ভাবলাম, আজকের রাতটাই হবে অনেকের জীবনের শেষ রাত। সেই রাতের ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করেন। আমার মনে হলো, অন্যদের জীবন থেকে নিজেকে আলাদা করে বেঁচে থাকাটা একেবারেই অর্থহীন। সচ্ছল সুখি জীবন, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি এসব তখন আমার কাছে অবাস্তব মনে হল। এই ঘটনাটি আমার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিল। সেখানেই আমার কাজের শুরু।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে তিনি বলেন, মানুষ বিদ্রোহে ফেটে পড়লেন। পাকিস্তানি সেনারা বাঙালিদের উপর নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা আমাদের বাড়িতেও এসেছিল। আমাদের সারি করে বেঁধে দাঁড় করেছিল। শেল অয়েল কোম্পানির চেয়ারম্যান চাইছিলেন, আমি যেন তাদের এবং আমি হেডকোয়ার্টারের মধ্যে লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে কাজ করি। আমি দেখলাম ওরা আমাদের দেশে নির্মমভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে। এর প্রতিবাদে আমি আমার চাকরি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেই। আমার মনে হল, এখানে মুক্তিবাহিনীতে যোগ না দিয়ে লন্ডনে গিয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বেশি কাজ করতে পারব। আমরা ভেবেছিলাম, যুদ্ধ চলবে দীর্ঘদিন। এই অবস্থায় হাতে কিছু টাকা থাকা দরকার। আমি আমার লন্ডনের বাড়ি বিক্রি করে দিলাম। বাংলাদেশ খুব দ্রুতই স্বাধীন হয়ে গেল। বাড়ি বিক্রির প্রায় পুরো টাকাই আমার রয়ে গেল। সেই টাকা দিয়ে আমি ব্র্যাক শুরু করলাম।
যুদ্ধের সময় দেখেছিলাম, দুর্দশাগ্রস্থ লোকেরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তারা ভারতে শরনার্থী শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। আমি তখনই ভেবেছিলাম, দেশ স্বাধীন হলে এই ১ কোটি শরনার্থীরা দেশে ফিরে আসবে। এসে দেখবে তাদের কিছুই নেই। আমি কাজের জন্য তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ দিলাম। আমি ছিলাম তাদের শিক্ষকের মতো। আমরা একসঙ্গে শিখতাম। সিদ্ধান্ত নেই, আমরা দেশের প্রতিটি বাড়িতে যাব। ডায়রিয়াজনিত শিশুমৃত্যুর হার কমাতে মায়েদের খাবার স্যালাইন বানানো শিখাবো। আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে গিয়েছিলাম। তখন পুরো দেশটাই হয়ে গিয়েছিল আমাদের কর্মক্ষেত্র।
অনেকেই ভেবেছিল, যেন নতুন জন্ম হয়েছে আমার। কারণ আমি একেবারেই অন্যরকম ধাছের মানুষ ছিলাম। লন্ডনে আমি খুবই পরিপাটি পোশাকের তরুণ ছিলাম। অনেকেই আমাকে লর্ড কেমডেন নামেও ডাকতেন। আমি যে জীবনে অভ্যস্ত ছিলাম, তাতে করে গ্রামে যাওয়া, গরীব মানুষদের সঙ্গে কাজ করা এই বিষয়গুলো অনেকেই মেলাতে পারত না। অবশ্য আমার কখনো মনে হয়নি আমি খুব একটা পরিবর্তন হয়েছি। আমি এখনো ভালো পোশাক পড়তে পছন্দ করি।
ভালো গান শুনতে পছন্দ করি। আসলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমি কী কাজ করছি? আমার স্ত্রী ব্র্যাকের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এটা অনেক সৌভাগ্যের ছিল আমাদের দুজনের নেতৃত্বে ব্র্যাক গড়ে উঠেছে। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিল তার। আমরা দুজনই হার্ভার্ডে গিয়েছিলাম ভিজিটিং স্কলার হিসেবে। তিনি ব্র্যাকের মাতৃস্বরূপ ছিলেন। তিনি প্রায়শই মানিকগঞ্জ যেতেন এবং গ্রামীণ কারুশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করতেন। যখন তিনি মারা গেলেন তার নামে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তুললাম, আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন। সেখানে বাংলাদেশের গ্রামীণ দরিদ্র কারুশিল্পীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হল। তার মৃত্যুর পর আমি ভেঙে পড়েছিলাম। তবে ধীরে ধীরে পুনরায় ব্র্যাকের কাজে মনোযোগ দিতে শুরু করি। নারী ও শিশুর জন্য কাজ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে যেন কোন মা মৃত্যু বরণ না করেন। আমি যখন বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবি, তখন দেশের প্রতিটি মানুষকে নিয়েই ভাবি। দেশের সব মানুষ রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে পারে না। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে বিশাল সম্পদ রয়েছে, সবাই তা উপভোগ করতে পারে না। আমি মনে করি প্রত্যেকের এসব ভাবার অধিকার থাকা উচিত। যদি বলা হয় ব্র্যাক দারিদ্র বিমোচনে মানুষকে সাহায্য করেছে, তবে আমি বলব ব্র্যাকের অবদান ঠিক অত বড় নয়। ব্র্যাক স্বাস্থ্যসেবা, ক্ষুদ্রঋণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছু কাজ করেছে। তবে দারিদ্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মূল ভূমিকা রেখেছে দরিদ্র মানুষরাই। তারা নিজেরাই কঠোর পরিশ্রম করে সাফল্য পেয়েছেন।
২০০১ সালে অ্যাপেলের শীর্ষ কর্মকর্তা স্টিফ জবসের সঙ্গে নৈশভোজে যোগ দিয়েছিলাম। স্টিভ প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশের বাইরে কর্মসূচি পরিচালনা করতে কেন ৩০ বছর সময় লেগে গেল? হাসি মুখে স্যার ফজলে হাসান বলেন, স্টিভ, আমি অন্য কোন দেশে কর্মসূচি নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি। আমি শুধু বাংলাদেশেই কাজ করতে চেয়েছি।
যুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ আফগান শরণার্থী তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে গেল। আমি ভাবলাম, আমরা আফগানিস্থানে গিয়ে কাজ করতে পারি। আমরা বাংলাদেশে মাইক্রো ফাইন্যান্স, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, এসব নিয়ে কাজ করছি। ভাবলাম এসব কাজ আফগানিস্থানেও করা যায়। আফগানিস্থানের অভিজ্ঞতা আমাদের মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে দিল। ভাবলাম বিশ্বের আরও অনেক দেশে আমাদের কাজগুলো করতে পারি। আমি নিজেকে ‘গ্লোবাল সিটিজেন’ ভাবি। ব্র্যাকের কাজ নিয়ে আমরা যেকোন দেশেই যেতে রাজি আছি।
আমার অবসর নেবার কোন পরিকল্পনা নেই। তবে আমাকে অর্ধ অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা বলা যেতে পারে। এখন আমি সকাল ১০টায় অফিসে আসি। আগে আসতাম সকাল ৮টায়। এখনও আমি সন্ধ্যা ৭টায় বাড়ি ফিরি। আমি দুপুরে অফিসেই বিশ্রাম নেই। আমি কখনও স্বীকৃতির জন্য কাজ করিনি। তবে ব্র্যাকের কাজ স্বীকৃতি পেলে কর্মীরা আনন্দিত হয়। আমি সেই কাজ করতে চাই যে কাজে দরিদ্রদের উপকার হয়। আমি পরিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করছি। আমি তৃপ্ত যে আমার জীবন বৃথা যায়নি। আমি একদিন থাকবো না কিন্তু ব্র্যাক থেকে যাবে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের চাহিদা পূরণে কাজ করে যেতে হবে ব্র্যাককে।
তিনি সবশেষে বলেন, জীবন ক্ষণিকের। তাই জীবনকে যথাসম্ভব সুখী, সৃজনশীল এবং অর্থবহকরে তোলাই আমাদের দায়িত্ব।