বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে উত্তাল ভারত। বেশ কয়েকটি রাজ্যেই গত সপ্তাহজুড়ে চলছে লাগাতার বিক্ষোভ। বিক্ষোভ দমাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে দেশটির পুলিশ। শুক্রবার বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে ছোড়া গুলিতে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে আট জন। দেশটির গণমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, ২৪ ঘন্টায় উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ছয় জন। পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, বিজনোর এলাকায় নিহত হয়েছেন দুই আন্দোলনকারী। এছাড়া, সামভাল, ফিরোজাবাদ, মিরুত ও কানপুরে একজন করে আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন। তবে দেশটির পুলিশ দাবি করেছে, তাদের গুলিতে কোনো আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়নি।
উত্তর প্রদেশ পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল ওপি সিং এনডিটিভিকে বলেন, আমরা একটি গুলিও ছুড়ি নি।
এদিকে, ম্যাঙ্গালোরে ঘোষিত কারফিউ ভেঙ্গে মিছিল বের করলে সেখানে গুলি চালায় পুলিশ। এতে নিহত হয়েছেন দুই জন। স্থানীয় পুলিশ সূত্রে এর সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে। শনিবার পর্যন্ত সেখানে কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে এবং পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার জন্য মোবাইল ইন্টারনেট স্থগিত করার আদেশ দেয়া হয়। দিনের বেলায় বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের সময় প্রকাশ্যে গুলি চালায় পুলিশ। এ ছাড়া, লক্ষেèৗতে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন আরো একজন। সেখানে আহত হয়েছেন অন্তত তিন আন্দোলনকারী। আহত হয়েছেন এক ডজনের বেশি পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১১২ জনকে।
শুক্রবার দিল্লিতে, মা-ি হাউজ এবং লালকেল্লার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে শত শত বিক্ষোভকারীকে আটক করে পুলিশ। আটকদের তালিকায় রয়েছেন বিরোধী নেতা ডি রাজা, সীতারাম ইয়েচুরি, নীলোৎপল বসু, বৃন্দা কারাত, অজয় মাকেন, সন্দীপ দীক্ষিত এবং শিক্ষাবিদ যোগেন্দ্র যাদব ও উমর খালিদ। হরিয়ানা থেকেও দিল্লিতে ঢোকার চেষ্টা করে বিক্ষোভকারীরা। তবে প্রশাসন পূর্বেই বন্ধ করে দেয় রাজ্যের সীমানা। সৃষ্টি হয় ব্যাপক যানজটের। আটকে পড়েন বিমানবন্দরগামী যাত্রীরা। প্রায় ৮ ঘণ্টা ব্যারিকেড দেয়া ছিল সেখানে।
সকাল থেকেই উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় জমায়েত নিষিদ্ধ করে পুলিশ। তবে সেখানেও বিক্ষোভ দেখা গেছে। বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা প্রায় ১০টি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। বারাণসীতেও ব্যাপক বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
শুক্রবার মুম্বইয়ে বিক্ষোভ করেন প্রায় ১৫,০০০ মানুষ। পশ্চিমবঙ্গেও হয়েছে আন্দোলন। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জী নিয়ে জাতিসংঘের অধীনে গণভোটের দাবি তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, একটা ভোট করা হোক। কারণ বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। আপনারা যা কিছু করতে পারেন না। আপনারা সব কিছুতে ভয় দেখাচ্ছেন, সমাজের স্তম্ভকে। বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধি টুইট করে তাতে লিখেছেন, কলেজ, টেলিফোন এবং ইন্টারনেট বন্ধ করার কোনো অধিকার নেই সরকারের। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ বন্ধ করতে এবং ভারতের কণ্ঠরোধ করতে ১৪৪ ধারা জারি করার কোনো অধিকার নেই সরকারের। এটি ভারতের আত্মার অপমান।
দিল্লিতে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা সম্প্রসারণ: নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দমাতে দিল্লিতে সম্প্রসারিত হয়েছে ইন্টারনেট ও টেক্সট মেসেজ সেবা বিচ্ছিন্নতা। নতুন বেশকিছু অংশেও এই সেবাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। বৃহস্পতিবার চার ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকে ভোডাফোন, ভারতি এয়ারটেলের ইন্টারনেট ও টেক্সট মেসেজিং সেবা। স্থানীয় সময় দুপুর ১টার দিকে পুনরায় চালু করা হয়। পরবর্তীতে সরকারের নির্দেশে ফের আরো বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সেবাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
খবরে বলা হয়, দিল্লির ইতিহাসে এই ইন্টারনেট শাটডাউন নজিরবিহীন। ভোডাফোন আইডিয়া ও ভারতি এয়ারটেল জানিয়েছে, তারা তাদের ডাটা সেবা বন্ধ রেখেছে। এয়ারটেলের ক্ষেত্রে ভয়েস কল সেবাও বন্ধ রাখা হয়েছে কিছু জেলায়।
ভোডাফোন আইডিয়া জানিয়েছে, সরকারের নির্দেশেই কিছু স্থানে ডাটা ও এসএমএস সেবা বন্ধ করেছে তারা। একাধিক টুইটে একথা জানায় মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানটি। ভারতীয় বিলিয়নার মুকেশ আম্বানির মালিকানাধীন জিয়ো ইনফোকমকেও কিছু এলাকায় সেবা সীমিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম।
রয়টার্স জানায়, নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের অনেকেই শিক্ষার্থী। এসব শাটডাউনের অন্যতম কারণ হচ্ছে, ওইসব শিক্ষার্থীদের অনলাইনে প্রতিবাদ গড়ে তোলা থেকে বিরত রাখা। ভারতীয় আইনজীবী ও নাগরিক অধিকার বিষয়ক কর্মী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, সরকার জনগণকে জড়ো হওয়া থেকে বিরত রাখতেই মোবাইল সেবা বিঘিœত করছে। এই সরকার নিজের জনগণকে ভয় পাচ্ছে। এটা লজ্জার বিষয়।
ভারতে বিক্ষোভ দমাতে ইন্টারনেট সেবা বন্ধের ঘটনা ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য নতুন নয়। এর আগে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়ার সময়ও অঞ্চলটিতে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চার মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট। গণতান্ত্রিক দেশের ইতিহাসে এটা দীর্ঘতম ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতার ঘটনা।
দিল্লিতে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালালেন ভীমসেনা প্রধান: বিক্ষোভে যোগ দিয়ে পুলিশের হাত গলে পালিয়ে গেছেন ভীমসেনা প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদ। শুক্রবার দুপুর নাগাদ সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে দিল্লির জামা মসজিদের কাছে বড় বিক্ষোভ হয়েছে। এ সময় সেখানে যোগ দেন ভীমসেনা প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদ। মসজিদ এলাকায় ওই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন তিনি। বিক্ষোভ ঘিরে সেখানে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হলে আটক করা হয় আজাদকে। কিন্তু পরে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান তিনি। এরপর সেখানে ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে নজরদারি চালায় দিল্লি পুলিশ।
বিক্ষোভ থেকে আটক সাবেক রাষ্ট্রপতির কন্যা শর্মিষ্ঠা: সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে শুক্রবার পুলিশের রোষানলে পড়েন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কন্যা শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বাড়ির কাছে কংগ্রেসের বিক্ষোভ আন্দোলন চলাকালীন আটক করা হয় দিল্লি কংগ্রেসের মহিলা শাখার প্রধান শর্মিষ্ঠাকে। এ সময় তিনি একটি টুইটের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এতে তিনি লিখেছেন, আমাদের আটক করে মন্দির মার্গ থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। পিটিআইকে তিনি জানান, দিল্লি মহিলা কংগ্রেসের প্রায় ৫০ জন নারী সদস্যকে আটক করে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ।
শুক্রবার ৮ম দিনে গড়ালো নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ইতিমধ্যে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও অধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, আইনটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের বিরোধী। এর মধ্য দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে। কারণ, নাগরিকত্ব সংশোধন আইনে শুধু মুসলিমদের বাদ রাখা হয়েছে। তাদের যুক্তি নাগরিকত্ব নির্ধারণে শুধু ধর্মবিশ্বাসকে ভিত্তি করা উচিত নয়। এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বহু বলিউড তারকা। কিন্তু সমালোচক, সচেতন মহলের এই উদ্বেগ প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। তিনি বলেছেন, বিরোধীরা মিথ্যা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আইনটি হওয়ার আগে থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়ে আসছে। বিক্ষোভের বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক আহ্বান করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
কেন মানুষ এই আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি। তারা বলছে, অনেক মুসলিম নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে যে, এই আইনের অধীনে যদি তারা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সংগ্রহ করতে না পারেন তাহলে তারা রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়তে পারেন। সমালোচকরাও বলছেন, এই আইনটি একটি গোষ্ঠীকে বাইরে রাখার জন্য এবং ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির লঙ্ঘন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদি বলছেন, এই আইনে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, জৈন, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধসহ ভারতীয় নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। আইনটির বিরোধিতার জন্য তিনি বিরোধী দলগুলোকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, তারা মিথ্যা ও গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে। সহিংসতায় উস্কানি দিচ্ছে। মিথ্যার একটি আবহ সৃষ্টি করছে।