অতি দ্রুত দুঃখ প্রকাশের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীকে কেউ একজন ধন্যবাদ দিতে পারেন। কিন্তু তার দুঃখ প্রকাশ যথেষ্ট নয়। অনেকের বিবেচনায় প্রকৃতপক্ষে তিনি আদৌ ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার নন। তিনি বা তার প্রশাসনের লোকেরা অযথা বেশি উৎসাহ দেখিয়ে সরকারকে অহেতুক বিব্রত করেছেন।
ভুল বেশি হলে অর্থাৎ শুধরে নেয়ার অনুপযোপী হলে, মন্ত্রী সেটি প্রত্যাহার করে নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু অনেকের জীবনে বা পরিবারের মানহানি যা ঘটার, তা ঘটে গেছে।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর মতো ব্যক্তিত্বের জন্য তা অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি এতদিন যুদ্ধাপরাধীদের মামলা চালিয়ে আলোচিত হয়েছেন। আর এখন তিনি রাজাকারের খাতা থেকে নাম কাটাতে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কিংবা রাজাকার না হয়েও যাদের নাম তালিকায় উঠেছে, তারা অসম্ভব রকম মানসিক আঘাত পেয়েছেন। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের তরফে শুধু দুঃখ প্রকাশ যথেষ্ট নয়।
অবশ্য অনেকে যুক্তি দিতে পারেন যে, সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিছু ভুল হতে পারে, অসাবধানতাবশত ভুল হতে পারে, ছাপার ভুল হতে পারে। কিন্তু তালিকা প্রকাশের পরের ৪৮ ঘণ্টায় খণ্ডিত হলেও এমন কিছু চিত্র স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট হয়েছে, তাতে প্রতীয়মান হতে পারে যে, তালিকায় কালো হাতের ছোঁয়া লেগেছে। বড় রকমের দূষণ ঘটেছে।
প্রমাণ মিলছে যে, এরকম একটি স্পর্শকাতর তালিকা প্রকাশের আগে সম্ভব সবরকম সতর্কতা অনুসরণ করা হয়নি। কিছু বিষয় আছে, ব্যক্তির চেয়ে তার প্রতীকী মূল্য অসাধারণ। গোলাম আরিফ টিপুর নামটি থাকা এ পর্যন্ত সব থেকে মারাত্মক ভুল বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ রাজাকার বাহিনী গঠন সংশ্লিষ্ট শীর্ষ নেতাদের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃতুদণ্ডসহ নানা গুরু দণ্ড দিয়েছেন। সেই বিচার প্রক্রিয়ার চিফ প্রসিকিউটর টিপুকে রাজাকারের তালিকায় দেখানোর ঘটনাটিকে অনেকেই ভুল বা অসাবধানবশত হিসেবে মানতে নারাজ। তাদের যুক্তি হলো, সার্বিক ঘটনা পরম্পরা বিবেচনায় নিলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, জনাব টিপুর নাম রাখা ষড়যন্ত্রমূলক। এবং তা সুদূরপ্রসারী ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। কারণ যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে কোনো কোনো মহলের বিশেষ আগ্রহ গোড়া থেকেই ছিল। আর সেটা গোপনীয় ছিল না। সংশ্লিষ্ট সবারই তা ভালো জানা ছিল।
এখানে স্মরণযোগ্য যে, এই চিফ প্রসিকিউটর পদে ‘রাজাকার’ নিয়োগ প্রচেষ্টার বিভিন্ন তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রাক বিচারপর্বে ছাপা হয়েছিল। সুতরাং অনেকের মতে, কোনো একটি সংঘবদ্ধ মহল যুদ্ধাপরাধ মামলাগুলোর প্রসিকিউশন টিমকে নানাভাবে বিতর্কের মধ্যে রাখতে ধারাবাহিকভাবে কলকাঠি নাড়তে পারে। অনেকের মতে, কোথাও একটা ধোঁয়াশার বিষয় রয়েছে, যা ভালোভাবে তদন্তের দাবি রাখে। বারংবার মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে কোনো না কোনো মাত্রায় বিতর্কের মধ্যে রাখা হচ্ছে। এটা কতটা সুপরিকল্পিতভাবে আর কতোটা কাকতালীয় সেটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। কিন্তু থেমে নেই। আর এমনসব কিছু ঘটছে, যা কারো পক্ষে অনুমান করাও অসম্ভব।
এর আগে স্কাইপি ঘটনা ফাঁস হয়েছিল। সময়ে সময়ে ভুল লোক বাছাইয়ের চেষ্টার খবর ছিল। আবার ব্যারিস্টার তুরিন কেলেঙ্কারির মতো ঘটনাও ঘটেছে। সেক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট মহলের তরফে এক ধরনের ‘সরি’ বলা হয়েছে।
রাজাকারের তালিকা তাড়াহুড়ো করে প্রকাশ করার কোনো বিষয় ছিল না। ৪৮ বছর বিলম্ব হয়েছে। শুধু আওয়ামী লীগ একাই চারপর্বে প্রায় সাড়ে ১৯ বছর দেশ শাসন করেছে, গত এক দশকটা ছিল শুধু তার। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র তারা নির্বিঘ্নে চালিয়েছে। ২০১৯ সালটি কোনো নির্বাচনী বছর নয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কোনো ব্যাপার নেই। বরং সময়টা মাত্র নির্বাচনের ঠিক পরের বছর। দেশে এমন কোনো আন্দোলন নেই, প্রতিপক্ষ যথেষ্ট দুর্বল হয়ে গেছে বা করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং কোনো বিবেচনাতেই তাড়াহুড়োর কোনো ব্যাপার ছিল না। এ ধরনের তালিকা প্রকাশের সাধারণত একটি আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে। কিন্তু স্বীকৃত মতে তাও ছিল না।
বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের প্রবীণ সদস্য তপন কুমার চক্রবর্তী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এটা খুবই লজ্জার বিষয়। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে শহীদ হয়েছেন। অথচ এত বছর পর রাষ্ট্র আমাকে ও আমার মাকে রাজাকারের খেতাব দিলো। এই লজ্জা, দুঃখ কোথায় রাখব?’
সাংবাদিক শাহরিয়ার কবীর বলেছেন, নির্মূল কমিটি মাঠপর্যায়ে বিষয়টি তদন্ত করবে। যদি প্রমাণিত হয়, ভুলভাবে কারও নাম যুক্ত হয়েছে, তাহলে তারা পুরো তালিকা প্রত্যাহার করতে বলবে। এ বিষয়ে তারা ২০শে ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করবে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নির্মূল কমিটিকে কেন যাচাইয়ের কাজ আগেভাগে দেয়া হলো না? প্রকাশ করে প্রত্যাহারের কথা কেন? আর ১০৭৮৯ জনের মধ্যে সকলের কাছে এই তথ্য পৌঁছে গেছে বা দ্রুত যাবে, সেটা মনে করার কারণ নেই। এরমধ্যে ধাঁধা হলো, সবার ঠিকানা বা পরিচয় নেই। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, যাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে মৃতদের কারো নাম নেই, সেকথা হলফ করে কে বলবে? কারণ বলা হচ্ছে, পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের তৈরি করা নথিপত্রের ভিত্তিতেও বর্তমান তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই নথির যথার্থতা করা কীভাবে যাচাই করল, তার উত্তর নেই।
উল্লেখ্য, রাজাকার একটি ঘৃণিত শব্দ, ফারসি এই শব্দটির অর্থ ছিল যদিও স্বেচ্ছাসেবী। কিন্তু এই রাজাকাররা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর দোসর ছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের চিনিয়ে দিয়েছেন, ধরিয়ে দিয়েছেন। নিজেরাও হত্যা করেছেন। তাই রাজাকাররা জাতির কাছে, প্রজন্মের কাছে অভিশপ্ত থাকবেন। সুতরাং অভিশপ্তদের তালিকা প্রকাশে আদালতের একটি সংশ্লিষ্টতা থাকা দরকার ছিল বলে অনেকে মনে করেন। কোনো বিচারবিভাগীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার কারণে, এরকম একটি রাজনৈতিক দুর্ঘটনা ঘটতে পারল বলেও কেউ কেউ মনে করেন।
৪৮ বছর পরে কেন শুদ্ধতার দিকে নজর দেয়ার চেয়ে ১৬ই ডিসেম্বরকে গুরুত্ব দেয়া হলো। রাজাকারের নানা বেসরকারি তালিকা তো ছিলই। সুতরাং এটা কেউ কখন শোনেনি, এই প্রথম মানুষকে জানানোর কোনো তাগিদ বা প্রয়োজনীয়তা ছিল না।
আর যখন সরকারিভাবে প্রকাশিত হলো, তখন সেটি এতটা ভয়ানকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, এতটা বিস্ময়, বেদনা বিশেষ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার তালিকায় রেখে দেয়ার ঘটনা ঘটতে পারে, তা অনেকেরই কল্পনা
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়নি, প্রকাশ করা হচ্ছে।’ অনেকের মতে, এর থেকে ভয়ঙ্কর যুক্তি আর কী হতে পারে। তার মানে কি? কবে কারা কি দলিলের ভিত্তিতে রাজাকার তালিকা প্রস্তুত করেই রেখেছিল। বিএনপি আমলে কারাবন্দি নেতার হাতেই তৈরি হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। তারা রাজাকার তালিকা করেছিল বলে জানা যায় না।
মন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের হেফাজতে যেসব দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাই প্রকাশ করা যায়। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য পেয়েছি।’ বিশ্লেষকরা বলেছেন, তার এই যুক্তি সঠিক না-ও হতে পারে। কারণ সবক্ষেত্রে সরকার মানেই শুদ্ধতম কানো বিষয় নয়। সরকারি সিল লাগলেই তা সত্য হয় না। বরং বাংলাদেশের ইতিহাস হলো, সরকারি তথ্য বা ব্যাখ্যাকে সবসময় সন্দেহের চোখে দেখা।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে রাজাকারদের অনেক রেকর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন মি. হক। যদি তাই হবে, তাহলে সেসব রেকর্ড পূরণ করা হলো কি প্রক্রিয়ায় সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন।
মুক্তিযোদ্ধাদেরও একটি আনুষ্ঠানিক তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে উল্লেখ করেন মি. হক। এই তালিকাটি প্রকাশ করা হবে আগামী বছর ২৬শে মার্চ। অনেকে রসিকতা করে বলছেন, এই তালিকা যেন রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর তালিকায় পরিণত না হয়। কে জানে হয়তো দেখা যাবে, যারা অতীতে কোনো না কোনো সময়ে রাজাকার হিসেবে দণ্ডিত হয়েছে, তারাও কেউ কেউ এসে গেছে এই তালিকায়। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের আগে প্রায় ৮শ ব্যক্তি দালাল আইনে দণ্ডিত হয়েছিলেন। অনেকেই আশা করবেন, আদালতে দণ্ডিতরা যাতে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার মতো তালিকা না দেখতে হয়।
রাজাকারদের প্রথম তালিকা সবে এলো। পরের তালিকা তৈরির কাজ এখনো বাকি রয়েছে বলে জানান তিনি। তবে এটাও বেশ লক্ষণীয় যে, মিস্টার হক অভিযোগ করেন, ‘তালিকা তৈরি করতে গিয়ে যথাযথ সহযোগিতা তারা পাননি। তার কথায়, সেই সময় ১৯টা জেলা ছিল। জেলা প্রশাসকদের বলা হয়েছিল ওই সময়ে তাদের রেকর্ড রুমের তালিকা দিয়ে তাদের সহযোগিতা করার জন্য। দুঃখজনক হলো সেইভাবে আমরা সহযোগিতা পাইনি।’ ১৯৭১ সালের সব গেজেট আমরা চেয়েছি। তার সবগুলো দিতে পারেনি।’