বিজয়ের ৪৮তম দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের। যাদের আত্মত্যাগ আর সাহসিকতায় আমরা পেয়েছি স্বাধীন মাতৃভূমি। বিজয়ের বার্ষিকীতে উচ্চারিত হয়েছে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার শপথ। মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে লাখো মানুষ। সারা দেশে পালিত হয়েছে নানা কর্মসূচি। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ফুলে ফুলে ভরে উঠে শহীদ বেদি। দিবসটি উপলক্ষে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়। সকালে ৩১বার তোপধ্বনির মাধ্যমে শুরু হয় দিবসের কর্মসূচি।
সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে উড়ানো হয় জাতীয় পতাকা। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ। এতে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ সালাম গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বিকালে বঙ্গভবনে সংবর্ধনার আয়োজন করেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ।
সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। এসময় বিউগলে বেজে উঠে করুণ সুর। এসময় গার্ড অব অনার প্রদান করে সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল। পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পর্যায়ক্রমে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নের্তৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের জনতা। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের আপস হবে না। সকালে একাত্তরে বীর শহীদদের শ্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, সামপ্রদায়িক অপশক্তির কারণে স্বাধীনতাকে এখনো সুসংহত করা যায়নি।
স্বাধীনতাবিরোধী সামপ্রদায়িক অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যে দোসর, তাদের প্রেতাত্মারা আজও বাংলার মাটিতে বিজয়কে সুসংহতকরণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বংশধরদের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো আপস নেই। তাই দলে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে কেউ থাকলে আগামী সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের বের করে দেয়া হবে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিই আওয়ামী লীগ করতে পারবে। এদিকে স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির হুমকির বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশ এখনও নিরাপদ হয়নি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সম্পূর্ণরুপে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাজাকার সমর্থিত সরকার যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে সে বিষয়ে নিশ্চিৎ হতে হবে। অন্যদিকে, সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, রাজাকারের তালিকাটি এখনও তার ‘পরীক্ষা’ করে দেখা হয়নি। ‘পরীক্ষা নিরীক্ষা’ করে তবেই তিনি মন্তব্য করবেন।
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। স্বাধীনতাকে অসম্ভব মনে করে একাত্তরে সারা পৃথিবী বলেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে পারবে না। কিন্তু আমরা সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলাম। ড. কামাল হোসেন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো স্বাধীনতা। জনগণের ঐক্যের শক্তিতে যেটা অর্জন করলাম। স্বাধীনতা অর্জনের পরে আমাদের কী কী লক্ষ্য, আমরা কী ধরনের সমাজ চাই, সমাজ পরিবর্তন চাই, ব্যবধান আছে ধনী এবং গরীবের মধ্যে, তা থেকে যদি আমরা মুক্ত করতে চাই সমাজকে, তাহলে সবাইকে এক হতে হবে। আমরা যদি বিভক্ত হয়ে থাকি, তাহলে যারা শোষণ করতে চায়, দুর্নীতি করতে চায়, তারা সুযোগ পেয়ে যায়। এগুলোকে মোকাবিলা করতে হলে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন আছে। তিনি আরো বলেন, সংবিধানে এটা আমরা লিখে দিয়েছি, চার মূলনীতি। চার মূলনীতির মধ্যে গণতন্ত্র হলো এক নম্বর মূলনীতি। সেটাকে কার্যকর করতে হলে দরকার অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন। সেটা হচ্ছে কী?, হচ্ছে না। জনগণের দাবির দিক থেকে আমরা নড়িনি।
জনগণ কী ধরনের নির্বাচন চায়- অবাধ, নিরপেক্ষ, এটা হচ্ছে কী, হচ্ছে না। দেশের রাজনীতিতে কালো টাকার যে অভিশাপ ঢুকানো হয়েছে, এ কালো টাকা সুস্থ্য রাজনীতিকে অসুস্থ্য রাজনীতিতে পরিণত করেছে। টাকা দিয়ে আমরা ভোট কিনছি, ভোটবাক্স ভর্তি করছি। ওদিকে সকাল ১০টার দিকে বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় স্মৃৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি বলেন, দেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে গণতন্ত্রকে মুক্ত করা হবে। যে চেতনার ভিত্তিতে আমরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, যে চেতনায় দেশ স্বাধীন করেছিলাম, এই চেতনার ভিত্তিতে দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্রকে মুক্ত করবো ইনশাআল্লাহ। বিএনপি মহাসচিব এসময় আরো বলেন, ৪৮ বছরেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তিন বারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি আজকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে বন্দি, দেশের গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হলে তাকে মুক্ত করতে হবে। এসময় অন্যান্যের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. মঈন খান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি ও ঢাকা-১৯ এর সাবেক এমপি ডা. দেওয়ান মো. সালাউদ্দিন প্রমূখ। ওদিকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে জাতীয় স্মৃতিসৌধে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। সব বয়সের মানুষের শ্রদ্ধার ফুলে ছেয়ে যায় শহীদ বেদি।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সকালে রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানান। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর স্বাধীনতার এই মহান স্থপতির প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে দলের জেষ্ঠ্য নেতৃবৃন্দকে নিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পরে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠন, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিভিন্ন সংস্থা, মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ,বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সাধারণ মানুষ সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
মনোজ্ঞ প্যারেড: ওদিকে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিজয় দিবস প্যারেড অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর বিভিন্ন কন্টিনজেন্ট, মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ, বিভিন্ন আধা সামরিক বাহিনী, বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এই আকর্ষণীয় প্যারেডে অংশগ্রহণ করে। জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারে সকালে ৪৯তম বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে এই বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় এবং সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ম পদাতিক ডিভিশনের তদারকিতে এই প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট একটি সুসজ্জিত খোলা জিপে করে কুচকাওয়াজ পরিদর্শনকালে ৯ম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আকবর হোসেন তার সঙ্গে ছিলেন। প্যারেড পরিদর্শন শেষে প্রেসিডেন্ট অভিবাদন মঞ্চে থেকে কুচকাওয়াজের সালাম গ্রহণ করেন । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ, সুসজ্জিত সাঁজোয়া বহর এবং বিমান বাহিনীর মনোমুগ্ধকর ফ্লাইপাস্ট ও অ্যারোবেটিক ডিসপ্লে প্রত্যক্ষ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত সচিব মো.আরিফুর রহমান এ সময় উপস্থিত ছিলেন। ভিভিআইপি গ্যালারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, উচ্চ পদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ ও তাদের পরিবারের সদস্য, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত-কূটনীতিক ও দেশী বিদেশী আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এদিকে, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ব্যান্ড দলের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যান্ড কন্টিনজেন্ট এই কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করে।