শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ভিন্ন মতাবলম্বী অং সান সুচি রাজনীতিবিদে পরিণত হয়ে এবার আবার বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছেন। যারা তাকে এখনো ‘প্রিজনার অব কনসায়েন্স’ হিসেবে স্মরণ করেন, তারা এই মনোযোগ আকর্ষণের কারণ জেনে বিস্মিত হতে পারেন। মিয়ানমারের বেসামরিক নেত্রী অং সান সুচি নতুন একটি মশাল হাতে নিয়েছেন। তা হলো, তার দেশে গণহারে নৃশংসতার মুখপাত্র।
হেগে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে তার দেশের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগের পক্ষে সাফাই গাইতে তিনি উপস্থিত হয়েছেন। বছরে পর বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়েছে তার দেশ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে চালানো দু’টি নৃশংস জাতিনিধন অভিযানে বাড়িতে মানুষ হত্যা, নারী ও যুবতীদের ধর্ষণ, পুরো সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ তদারকি করেছে সেনাবাহিনী। এর শিকার হয়ে কমপক্ষে ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
সামরিক জান্তার সমালোচনা করার জন্য অং সান সুচিকে ১৫ বছর গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। এর পরে বাইরের অনেকে, বিশেষ করে তার দীর্ঘদিনের সমর্থনদাতা পশ্চিমারা মনে করেছিলেন, সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ি খর্ব করতে তিনি তার ক্ষমতা ও নৈতিকতার অবস্থানকে ব্যবহার করবেন। কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি দমন-পীড়নের পক্ষ নিয়েছেন। দাবি করছেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর আচরণ সম্পর্কে মিথ্যা খবরের ‘আইসবার্গ’ সৃষ্টি করছে।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ছিলাম। এ সময়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ নেয়ায় সুচির যে প্রচেষ্টা তাতে আমি বিরক্ত হয়েছি। তার উদ্বেগজনক অনেক চিহ্নের মধ্যে অন্যতম হলো তার ফেসবুক পেজ। সেখানে তিনি তার অভ্যন্তরীণ সব জনসংযোগ বিষয়ক পোস্টের জন্য এটা ব্যবহার করে থাকেন। যৌন সন্ত্রাসের হাত থেকে বেঁচে থাকা একটি রিপোর্টের উল্লেখ করে তাতে লাল ব্যানার দেয়া হয়েছিল। তাতে লেখা ‘ফেইক রেপ’। তার আচরণ ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে অনেকে বলেছেন, স্টেট কাউন্সেলর হিসেবে সুচি এমন একজন ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন, যিনি সেনাবাহিনীর কাছে মাথা নত করে দিয়েছেন। কিন্তু অন্তত কেউ তার কাছ থেকে, নীতিগত এই ভিন্নমতাবলম্বীর কাছ থেকে কিছুটা বিরোধিতা প্রত্যাশা করতে পারেন।
তার পরিবর্তে, দু’বছর পরে, আন্তর্জাতিক আদালতে তিনি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার পক্ষে কথা বলছেন। তার দেশের সন্ত্রাসের হুমকিকে সমালোচকরা খাটো করে দেখছেন এমনটা দাবি করে হেগে যাত্রাকে মিয়ানমারের ‘জাতীয় স্বার্থের’ জন্য লাড়ই বলেছেন। রোহিঙ্গাদের নির্যাতনে তার সমর্থন এই নৃশংসতাকে জনপ্রিয়তা এনে দিতে সহায়তা করেছে। একটি র্যালির এক আয়োজক বলেছেন, যদি একটি দেশের নেতা বলেন যে, লেবু মিষ্টি, তাহলে আমাদেরকেও বলতে হবে তা মিষ্টি।
কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কৌতূহল এবং প্রাসঙ্গিক কথা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের বিচারিক কার্যে কোনো উপকারে আসবে না। সেখানে প্রকৃত সত্যই মূল। আর এই প্রকৃত সত্য জমা হচ্ছেই। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন তাদের রিপোর্টে বলেছে, গণহত্যা প্রতিরোধে, গণহত্যার তদন্ত করতে যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাতে ব্যর্থ হচ্ছে মিয়ানমার। একই সঙ্গে গণহত্যার জন্য বৈধভাবে ক্রিমিনালাইজিং করা ও শাস্তি দেয়ার বিষয়েও ব্যর্থ হচ্ছে মিয়ানমার।
অবশেষে গত মাসে মিয়ামনারের বিরুদ্ধে আইসিজে’তে মামলা করেছে গাম্বিয়া। গাম্বিয়ার নেতারা যে কথাগুলো বলেছেন তা ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনের। গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবু বাকার তামাবোদুউ বলেছেন, আমাদের এ প্রজন্মের কাছে এটা এক লজ্জা যে, আমাদের নিজেদের চোখের সামনে যখন গণহত্যা হচ্ছে তখন আমরা কিছু করছি না।
আইসিজে’র বিচার প্রক্রিয়া হয়তো মিয়ানমারে অবস্থানরত আরো কমপক্ষে ৫ লাখ রোহিঙ্গার জীবনে বাস্তব প্রভাব ফেলবে। যখন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার একই পরিস্থিতির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তখন আদালত দেখতে পেয়েছিল যে, গণহত্যা বন্ধে এবং এর জন্য দায়ীদের শাস্তি দেয়ার যে দায় ছিল তা লঙ্ঘন করেছে সার্বিয়া। এক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল এমন একটি নির্দেশ যে, বসনিয়া আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইতে পারে এবং তা গ্রহণ করতে পারে বসনিয়া এবং বিদেশিরা সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারবে। আদালতের কাছে একই রকম পদক্ষেপ দাবি করেছে গাম্বিয়া। তাতে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিষ্পেষণ বন্ধ করতে বলা হয়েছে। যদি আদালত তাদের পক্ষে রায় দেন তাহলে তা মিয়ানমার সেই সিদ্ধান্ত আইনগতভাবে মানতে বাধ্য এবং এই সিদ্ধান্ত জোর করে মানতে বাধ্য করাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ।
১৯৯১ সালে ‘ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার’- শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন অং সান সুচি। এতে তিনি লিখেছিলেন সত্য, ন্যায়বিচার ও অনুকম্পাকে গতানুগতিক বলে সরিয়ে রাখা যায় না যখন তা শুধু নির্মম শক্তির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার উপায় হয়।
মিয়ানমার সরকারের বেসামরিক একজন প্রধান হিসেবে তিনি রোহিঙ্গাদের দুর্দশার সত্য থেকে এবং ন্যায়বিচারকে বন্ধ করতে বহুদূর সরে গিয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্তকারীদের তার দেশে প্রবেশে অনুমতি দেয়নি তার প্রশাসন। একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্যে এখনও বসবাস করা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে সাহায্য করার জন্য ত্রাণকর্মীদের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। গণহারে মানুষ দেশত্যাগের পরে তাদের গ্রামগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।
যখন মিয়ানমারের কূটনীতিকরা বলেন যে, জাতিসংঘের এজেন্সিগুলোর রিপোর্ট সরকার গ্রহণও করে না, এর সঙ্গে একমতও নয়, তখন তাদের জন্য এখন অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হবে, যেখানে সরকারের মূল নেত্রী অং সান সুচি আইসিজে’র মুখোমুখি।
গৃহবন্দি থাকাকালে অং সান সুচি লিখেছিলেন, এটা দুর্নীতিবাজদের শক্তি নয়। এটা হলো আতঙ্ক। যারা দুর্নীতি করে তাদের ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক।
তিনি এখন প্রমাণ করেছেন যে, এই নিয়মের বাইরে নন তিনিও।
(লেখক জর্ডানের কূটনীতিক। তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জাতিসংগে মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে)