প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণে বিশেষ করে যুবসমাজের বিদ্যমান ব্যাপক মেধার সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রচুর সংখ্যক মেধাবী লোকজন রয়েছে এবং মেধার বিবেচনায় আমরা অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছি। মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণে এই মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে আমাদেরকে বিশ্বের দরবারে একটি মর্যাদার আসন করে নিতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী আজ এখানে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তথ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৭ ও ২০১৮’ বিতরণকালে এই বিষয়টির ওপর বিশেষ মনোযোগ দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের শিল্পীরা প্রতিবেশী দেশে গিয়ে ভাল কাজ করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদেরকে আমাদের চলচ্চিত্রের প্রতি অন্যান্য দেশকে আকর্ষণ করতে একই কাজ এমনকি আরো ভালো করতে হবে।’ তিনি সকল পুরস্কার বিজয়ীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আপনাদের ভালো কাজের স্বীকৃতি দিতে এবং আপনাদের আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগাতে এই পুরস্কার।’
প্রধানমন্ত্রী বর্তমান সময়কে ডিজিটাল সময় উল্লেখ করে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আরো বেশি মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণে যুবসমাজের মধ্যে নিহিত মেধা, সৃজনশীলতা ও ধ্যান-ধারণাকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ডিজিটাল দেশ। কেননা, এটি ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর উৎক্ষেপণ করেছে এবং দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যুবসমাজের চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসাকে প্রশংসা করে তিনি তাদের মেধা বিকাশের লক্ষ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং তাঁর সরকারের প্রতিষ্ঠিত ফিল্ম ইন্সিটিটিউট থেকে মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর যথাযথ প্রশিক্ষিণ গ্রহণের আহ্বান জানান।
তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান ও তথ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় অস্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
তথ্য সচিব আবদুল মালেক অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
মন্ত্রীবর্গ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যগণ, ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাগণ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
শেখ হাসিনা চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকদের প্রতি সিনেমা নির্মাণে সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন,কারণ এর মাধ্যমে সমাজ সংস্কার অথবা এর বিনাশের সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর সমাজ বিনষ্টের অশুভ প্রচেষ্টার উল্লেখ করে বলেন, ‘একজন চল”িত্রের মাধ্যমে সমাজের একটা সাধারণ চিত্র পেতে পারেন,এছাড়া চলচ্চিত্র সমাজে সহজেই তথ্য পৌঁছে দেয়।এটি একদিকে যেমন সমাজের সংস্কার করতে পারে অন্যদিকে খারাপ সংস্কৃতি (চলচ্চিত্র কর্তৃক সৃষ্ট) এমনকি একটি সমাজ ধ্বংসও করতে পারে।’
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর সমাজকে এমন একটা পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়া হয় যে জনগন তাদের পরিবারের সকলকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতে পারেনি।
তিনি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট লোকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘অবশ্য আমরা ওই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসেছি। সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি সমাজের কল্যাণের বিষয় বিবেচনায় রেখে এখন চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়ায় এর প্রতি জনগণের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক পরিবর্তনের ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্বলিত ডিজিটাইজড সিনেমা হল নির্মাণে তার সরকার প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে।
তিনি বলেন, ‘উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিনোদনের জন্য সিনেমাকে ডিজিটালাইজড করাসহ অধিকতর সুযোগের ব্যবস্থার বিষয়ে আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে।’
ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে অমূল্য সম্পদ হিসাবে বর্ণনা করে তিনি সকলের প্রতি দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশের অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্বলিত সিনেমা তৈরির আহ্বান জানান, যা আন্তর্জাতিক প্রশংসা অর্জন করবে।
প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্র উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করেন বলেন, বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে ‘ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করর্পোরেশন’নামে বিল উত্থাপন করে প্রথম বাংলাদেশে একজন বাঙ্গালী কর্তৃক চলচ্চিত্র নির্মানের সুযোগ সৃষ্টি করেছিলেন। শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিএফডিসি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেনএবং চলচ্চিত্রের সার্বিক উন্নয়নে অন্যন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর বাঙ্গালীর আর্ট ও সংস্কৃতির কন্ঠ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করে অপপ্রচার চালানো হয়। ৭৫ পরবর্তী অবৈধ সরকার চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংসের অশুভ প্রচেষ্টা চালায় এবং এর ফলে এই শিল্প ধ্বংশের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়।
চলচ্চিত্রকে শক্তিশালী মাধ্যম উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এই মাধ্যমকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে মানুষের মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। তিনি বলেন, ‘সমাজের ইতিবাচক দিক ফুটিয়ে তুলার মাধ্যমে চলচ্চিত্র মানুষকে সৎ পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী চিত্র নির্মাতাদের আরো বেশি জীবনমুখী চলচ্চিত্র নির্মাণের আহ্বান জানান, যা মানুষের ভেতরের সৌন্দর্য সৃষ্টিতে এবং তাদেরকে মাদক, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতি থেকে দূরে রাখতে সহায়ক হয়। শুধু অভিযান এসব অনাচার বন্ধে যথেষ্ট নয়।
চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে তার সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা শিল্পমানসম্মত ও সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণে গুরুত্ব দিতে জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা ২০১৭ প্রণয়ন করেছি। এছাড়া, চলচ্চিত্র বিকাশে এবং যৌথ বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে যৌথ উদ্যোগে চলচ্চিত্র নীতিমালা ২০১৭ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬টি যৌথ উদ্যোগ চলচ্চিত্র সরকারি অনুমোদন লাভ করেছে।’ তিনি বলেন, চলচ্চিত্রকে অপসংস্কৃতি, নগ্নতা ও সামাজিক অবক্ষয় থেকে কার্যকরভাবে সুরক্ষার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট আইন ও নিয়ম-কানুন মেনে চলে চলচ্চিত্রের সেন্সর করা হচ্ছে কি-না, তা দেখাশোনা করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু চলচ্চিত্র নগরীর প্রথম ধাপের কাজ শেষ হয়েছে এবং দ্বিতীয় ধাপ শিগগির শুরু হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক ধারার সাথে তাল মেলাতে রেটিং সিস্টেমের ভিত্তিতে একটি প্রত্যয়ন আইন বলবৎ করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ৩২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বিএফডিসি নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া ইতোমধ্যে বিএফডিসি’র আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুরোনো চলচ্চিত্র সংরক্ষণ এবং এর মাধ্যমে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সুরক্ষায় সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সমন্বিত বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইড ভবন নির্মাণ হয়েছে। এছাড়া ১০৪.১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬ তলাবিশিষ্ট আধুনিক তথ্যভবন নির্মাণ করা হয়েছে এবং প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ ও জাতীয় গণসংযোগ ইনস্টিটিউট সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সূত্র : বাসস