বিদ্যুতের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব

Slider জাতীয় বাংলার মুখোমুখি সারাদেশ


ঢাকা: বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) পাইকারি বিদ্যুতের দাম ২৩ দশমিক ২৭ ভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন ভোক্তারা। তারা বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী বাজারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব মানি না। এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে সবকিছুতেই এর প্রভাব পড়বে বলে তারা মনে করেন। কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়বেন। তারা বলেন, বিদ্যুত খাতের ৫০ শতাংশ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। গতকাল রাজধানীর ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) অডিটোরিয়ামে পিডিবি’র পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর গণশুনানিকালে বিভিন্ন শ্রেণীর ভোক্তারা এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এই শুনানির আয়োজন করে।

পিডিবি পাইকারি বিদ্যুতের দাম ২৩ দশমিক ২৭ ভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বিপরীতে কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন বলে মনে করছে। পিডিবির পক্ষ থেকে দাম প্রস্তাব উপস্থাপন করেন পিডিবির জেনারেল ম্যানেজার কাউসার আমীর আলী। অন্যদিকে মূল্যায়ন কমিটির পক্ষে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন কমিশনের উপপরিচালক (ট্যারিফ) মো. কামরুজ্জামান। আগামী বছর প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসানের পূর্বাভাস দিয়ে বিইআরসির দ্বারস্থ হয়েছে পিডিবি। পিজিসিবি চায়, চার বছর আগে নির্ধারণ করা তাদের সঞ্চালন চার্জ তিন ধাপেই বাড়ানো হোক।

গণশুনানিতে অংশ নিয়ে ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, স্বচ্ছতা ও সততার সঙ্গে অনুসরণ ছাড়া পাইকারি বিদ্যুতের মূলহার নির্ধারণ ন্যায্য যৌক্তিক হবে না। মূলহার বৃদ্ধিও প্রস্তাব তখনই যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত হবে যখন ঘাটতি যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত হবে। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, ঘাটতি কি যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত। তিনি বলেন, পিডিবিকে ভোক্তারা বিদ্যুৎ খাত পরিচালনায় আদর্শিক মানদন্ড হিসেবে দেখতে চায়। এটি সরকারি সংস্থা। মুনাফা আহরণকারী কোম্পানি নয়। তার ট্যারিফ কস্ট প্লাস নয়, কস্টভিত্তিক হবে। ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৭০ হাজার কোটি টাকা মজুত। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এ অর্থ এখাত উন্নয়নে কি কোনো উদ্যোগ আছে। বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব এডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল গণশুনানিতে বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী বাজারে সাধারণ মানুষ খুব যন্ত্রণার মধ্যে আছেন। ২০১০ সালের মার্চ থেকে এই পর্যন্ত আটবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। তাই এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর দাবি জানান তিনি। শুনানিতে বিদ্যুতের কুইক রেন্টালগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেন বিএনপির এই নেতা। তিনি জনগণের ভোগান্তি কমানোর জন্য বিইআরসি’র প্রতি আহবান জানান। শুনানিতে বিজিএমইএর প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন চৌধুরী ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এবছর তৈরি পোশাক শিল্পের ৬৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে আরো অনেক কারখানা বন্ধের উপক্রম দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে চার কোটি লোক জড়িত। সরাসরি জড়িত ৪৪ লাখ মানুষ। এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে আরো বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর দাবি জানান বিজিএমইএর এই প্রতিনিধি। বিকেএমইএর প্রতিনিধি সজিব হোসেন বলেন, তাদের ১২শ’ কারখানার মধ্যে ইতিমধ্যেই ৬শ’ বন্ধ হয়ে গেছে।

বিদ্যুতের দাম বাড়ালে অন্য কারখানাগুলোও দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই বলেও তিনি মনে করেন। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি গণশুনানিতে অংশ নিয়ে বলেন, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তারমধ্যে আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা বলছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব কিছুর দাম বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, সরকার বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্য কুইক রেন্টাল করেছে। বিদ্যুতের ভুল নীতি ও দুর্নীতির কারণে রয়েছে বিশেষ গোষ্ঠীর সুবিধা। তিনি বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর দাবি জানান। সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বিদ্যুৎ সেক্টরে দুর্নীতির হাঙ্গার ও কুমির রয়েছে। এখানে সর্বত্র দুর্নীতি। এখাতে ৫০ শতাংশ দুর্নীতিরোধ করতে পারলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে না। মুঠোফোন গ্রাহক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতি রয়েছে। এজন্য অডিটি করার প্রয়োজন। এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়লে জীবনযাত্রার ওপর চরম প্রভাব পড়বে। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব মানি না। গণশুনানিতে অংশ নিয়ে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন। তিনি বৈঠকে কমিশনের একজন সদস্যকে ইঙ্গিত করে বলেন, বড় পুকুরিয়া কয়লা খনির কেলেঙ্কারি সঙ্গে জড়িত ওই সদস্য কিভাবে গণশুনানিতে অংশ নেন। তখন মিলনায়তনে উপস্থিত প্রায় সকলেই তার বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়ে, হৈচৈ শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি শান্ত হলে শুনানি আবার শুরু হয়।

এদিকে বিকালে একই স্থানে গণশুনানিতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন খরচ ২৭ পয়সা থেকে ৫০ দশমিক ৭৭ শতাংশ বাড়িয়ে প্রায় ৪২ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। কিন্তু বিইআরসি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ দাম বাড়ানো প্রয়োজন বলে মতামত দিয়েছে। পিজিসিবির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অর্থ আইন-২০১৯ অনুযায়ী সঞ্চালন চার্জের ওপর ৫ শতাংশ উৎসে কর কাটার বিধান রাখা হয়েছে। এতে বছরে প্রায় ১০৫ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। চার্জ না বাড়লে প্রকল্প বাস্তবায়ন, নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়বে। পিজিসিবির এমডি গোলাম কিবরিয়া বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। কিন্তু পিক, অফ পিক আওয়ার ও শীতকালে চাহিদার ব্যাপক তারতম্যের কারণে পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে কাঙ্ক্ষিত হুইলিং চার্জ অর্জিত হচ্ছে না। সঞ্চালন খরচ না বাড়লে সরকার ও দাতা সংস্থার ঋণ এবং সুদের বিশাল অংক নিয়মিত পরিশোধ করা কঠিন হবে। এতে অদূর ভবিষ্যতে ঋণ পরিশোধে অক্ষম একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

শুনানিতে কমিশনের চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম, কমিশনের সদস্য মিজানুর রহমান, আব্দুল আজিজ খান, রহমান মুরশেদ ও মাহমুদউল হক ভূইয়া উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *