বাংলাদেশি রোগীরা কেবলমাত্র কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য বছরে বিদেশে আনুমানিক ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় করেন। ২০১৮ সালের সংশোধিত ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯’ এ কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়ে কোনো সুব্যবস্থা না থাকায় এমনটা হচ্ছে। তাই প্রয়োজন দ্রুত আইনের সংস্করণ। গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এসব কথা বলেন। ‘২০১৮ সালের সংশোধিত মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯-এর অসম্পূর্ণতা ও সমস্যা সম্পর্কে অবহিতকরণের উদ্দেশ্যে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে
গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। তিনি বলেন, কেউ যদি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রি করার অধিকার রাখে তাহলে সুস্থ সবল মানুষ দুটো কিডনি থেকে একটি দান বা বিক্রি করে দেয়ার অধিকার রাখে। এজন্য কিডনি দাতা ও গ্রহীতার কোনো সমস্যা হয় না।
তবে সংশোধিত আইনে কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়ে কোনো সুব্যবস্থা নেই।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষের কিডনি পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়। এটা বড় কোনো অপারেশন নয়। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ কিডনি প্রতিস্থাপন করে। কিডনি প্রতিস্থাপনের বিপরীতে যে চিকিৎসাটি রয়েছে সেটা হলো ডায়ালাইসিস, যা অত্যন্ত বয় বহুল। কিন্তু কিডনি প্রতিস্থাপন করলে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয় দেশে। আমাদের দেশে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয় সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষেরা। যাদের ডায়ালাইসিস করার মতো এত টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই। এক্ষেত্রে যদি প্রতিস্থাপনের দিকে যাওয়া হয় তাহলে ভালো হয়। তিনি বলেন, প্রতিস্থাপনের একবছর পর্যন্ত প্রতিমাসে দুই হাজার টাকার ওষুধের প্রয়োজন হয়। আর যদি ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে ওষুধের দাম হবে মাত্র ৫০০ টাকা।
বাংলাদেশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাংযোজন আইন প্রসঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ২০১৮ সালের সংশোধিত মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ এর পরিধি অত্যন্ত সীমিত ও সংকীর্ণ। কিডনি প্রতিস্থাপনের কোন সুব্যবস্থা আইনে নাই। দেশে মানুষের জীবন-কাল বেড়েছে অথচ দাতা ও গ্রহীতার বয়স ৬৫ থেকে ৭০ বছরে সীমিত করা হয়েছে। আইনের ধারা ৭/১ (খ) এবং ৭/২ (ক) জেলা শহরে অধ্যাপক পদমর্যদার চিকিৎসক না থাকায় মেডিকেল বোর্ড গঠন সম্ভব হবে না। প্রত্যয়ন বোর্ড (৯ক) ক্যাডাভেরিক জাতীয় কমিটি ঢাকায় সীমিত থাকবে (৯/২/ক) ক্যাডাভেরিক দান সম্পর্কে আইনে ৫ পৃষ্ঠা ব্যয়িত হয়েছে। বর্তমান দাতা এবং গ্রহীতা উভয়কে মিথ্যা বলতে প্রভাবিত করছে এবং দায়িত্ব বর্তাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিংসকের ওপর। ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, এই আইনে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। উন্নত দেশসমূহ ও ইরানের মতো সুস্থ আত্মীয় ও অনাত্মীয় সবার অঙ্গদানের সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। আমাদের আশেপাশের দেশগুলোতেও আইন এ ধরনের অধিকার হরণমূলক নয়। কিডনি দানে প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৯০ করে আইন সংশোধন বিষয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেক জেলায় একটি প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ থাকবে যার সভাপতি হবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি/ চিকিংসক/ সিনিয়র শিক্ষক/সাংবাদিক/মুক্তিযোদ্ধা/ দানশীল ব্যক্তি। তিন ধরনের জীবিত অঙ্গদান আইনসিদ্ধ হবে-জীবিত আত্মীয় থেকে দান, জীবিত অনাত্মীয় থেকে দান, বন্ধুত্ব ও আবেগজনিত কারণের নিমিত্তে।
আর অঙ্গদানকারীকে ইরানের ন্যায় ন্যূনতম ৫ লাখ টাকা পুরস্কার এবং প্রয়োজনে দাতার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিকিংসা সুবিধা প্রদান করতে হবে। অঙ্গপ্রতিস্থাপনকালে চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল না হলে শৈল্য চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশ ও এই চিকিৎসার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, দেশে প্রতিবছর ১০ হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। কিন্তু দেশে হচ্ছে মাত্র ২০০ থেকে ২৫০টি। যেখানে রোগীরা আইনের ভয়ে দানকারীকে মিথ্যা সম্পর্কে নিকটাত্মীয় বানিয়ে নেয়। প্রায় ১ হাজার ৫০০ বিকল কিডনি রোগী ভারত ও শ্রীলঙ্কায় গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করায়, এতে প্রতিজনের ৩০ লাখ টাকার অধিক ব্যয় হয়। ধনী ব্যক্তিরা সিঙ্গাপুর ও আমেরিকায় গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করেন। সেখানে এক থেকে তিন কোটি টাকা ব্যয় হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশি রোগীরা কেবলমাত্র কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য আনুমানিক ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় করেন? অপরপক্ষে প্রত্যেক জীবিত দাতাকে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দিলে সরকারের ব্যয় হবে ৫০০ কোটি টাকা। জনগণের অর্থসাশ্রয় হবে ৩০০ কোটি টাকা। সঙ্গে দেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতি হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, কিডনি দানে আসলে আমাদের আরেকটা বাধা হলো ধর্মীয় গোড়ামি।
মৃত মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেয়া এ জন্য সম্ভব হয় না। যদিও জীবিতদের কিডনি বেশি কার্যকর। কিন্তু ইরানের মতো মুসলিম দেশে কিন্তু সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন হয়। আর কিডনি দান করার পর দাতা গ্রহীতা বড় কোনো রোগে আক্রান্ত না হলে বেঁচে থাকতে কোনো সমস্যা হয় না। ৯৫ শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপন সফল হয়ে থাকে। আগামী বছর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এখানে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হলে গরিদের খরচ হবে দেড় লাখ এবং ধনীদের জন্য আড়াই লাখ টাকা লাগবে। তাছাড়া কৃত্রিম কিডনি (মেশিন) বাংলাদেশে সহজলভ্য হতে আরো ১০ বছর লেগে যেতে পারে। আর বর্তমানে প্রায় ১০ জন সার্জন রয়েছেন দেশে। প্রতিস্থাপন চালু হলে এ সংখ্যাকে ১০০ জনে দাঁড় করাতে একবছর সময় লাগবে বলেও মনে করেন তিনি।