পিয়াজ, চালের পর এবার লঙ্কাকাণ্ড লবণের বাজারে। গুজব ছড়িয়ে তৈরি করা হয়েছে দেশজুড়ে অস্থিরতা। গুজবে কান দিয়ে লবণ কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্রেতারা। একেক জন প্রয়োজনের অতিরিক্ত লবণ কিনে নেয়ায় দোকানে দোকানে লবণের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যদিও মন্ত্রণালয় এবং বিসিকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দেশে পর্যাপ্ত লবণ মজুত রয়েছে। গুজবে কান না দিয়ে প্রয়োজনের বেশি লবন না কেনার আহবান জানানো হয়েছে। এদিকে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হয়ে যাওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়তি দামে লবণ বিক্রি হয়েছে। সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা কেজির লবন ৫০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল থেকেই সারা দেশে বাজার পর্যবেক্ষণ শুরু করেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও সতর্ক করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে লবণ নিয়ে গুজবে কান না দিতে জনগণকে আহবান জানিয়ে মাইকিং করা হয়েছে। রাতে সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান মোস্তাক হোসেন বলেন, লবণের কোনো স্বল্পতা নেই। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ লবণ মজুদ রয়েছে তা চাহিদার চেয়েও অনেক বেশি। এদিকে ব্যবসায়ীরাও বলছেন, দেশে লবণের কোনো সংকট নেই। গত মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ লাখ টন। বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ ২৪ হাজার টন। যা গত ৫৮ বছরের লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, লবণের দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে সোমবার সন্ধ্যার পর সিলেট, হবিগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, নেত্রকোনা জেলায় গুজব ছড়ায় এবং তাতে লবণ কেনার হিড়িক পড়ে। দামও বেড়ে যায়।
সরজমিন গতকাল বেলা তিনটায় রাজধানীর কাওরান বাজারের কিচেন মার্কেটের দোকানগুলোয় লবণ কিনতে প্রচুর মানুষের ভিড় দেখা গেছে। কেউ দুই কেজি, কেউ ৫ কেজি লবণ কিনছিলেন। এমনকি বন্ধ দোকান খুলেও অনেক বিক্রেতা লবণ বিক্রি করেন। বাজারে এখন সবচেয়ে ভালো মানের লবণের প্যাকেটের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা ৩৫ টাকা। আর সাধারণ লবণের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২৫ টাকা। খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিপণনকারী কোম্পানি এক কেজি লবণ বিক্রি করেন ২৫ থেকে ২৬ টাকা দরে। এত দিন কাওরান বাজারের মতো বড় দোকানে এসব লবণ ৩০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যেত। এদিকে ক্রেতাদের বাড়তি চাপ থাকায় খুচরা বিক্রেতারাও ছাড় দিয়ে বিক্রি করছেন না। আবার দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে চড়া দামে লবণ বিক্রির খবর আসছে। লবণের বাজারের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এসিআই সল্ট বলছে, লবণের কোনো ঘাটতি নেই। তারা লবণের দাম কোনোভাবেই বাড়ায়নি এবং বাড়াবে না। বরং নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি কেউ এসিআইয়ের লবণ বিক্রি করছে কি না, সেটা তারা নজরে রাখবে।
এদিকে শিল্প মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে সাড়ে ৬ লাখ টনের বেশি ভোজ্যলবণ মজুত রয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের লবণচাষিদের কাছে ৪ লাখ ৫ হাজার টন এবং বিভিন্ন লবণ মিলের গুদামে ২ লাখ ৪৫ হাজার টন লবণ মজুত রয়েছে।
এ ছাড়া সারা দেশে বিভিন্ন লবণ কোম্পানির ডিলার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে লবণ মজুত রয়েছে। পাশাপাশি চলতি নভেম্বর মাস থেকে লবণের উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া ও মহেশখালী উপজেলায় উৎপাদিত নতুন লবণও বাজারে আসতে শুরু করেছে।
দেশে প্রতি মাসে ভোজ্যলবণের চাহিদা কমবেশি ১ লাখ টন। অন্যদিকে, লবণের মজুত আছে সাড়ে ৬ লাখ টন। সে হিসাবে লবণের কোনো ধরনের ঘাটতি বা সংকট হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একটি স্বার্থান্বেষী মহল লবণের সংকট রয়েছে মর্মে গুজব রটনা করে অধিক মুনাফা লাভের আশায় লবণের দাম অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
লবণ সংক্রান্ত বিষয়ে তদারকির জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) প্রধান কার্যালয়ে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। এর নম্বর হচ্ছে: ০২-৯৫৭৩৫০৫ (ল্যান্ড ফোন), ০১৭১৫২২৩৯৪৯ (সেল ফোন)।
এদিকে গতকাল সকাল থেকে শত শত কেজি লবণ বিক্রি হয়েছে রাজধানীর পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে। দোকানিরা জানেন না, নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের চাহিদা হঠাৎ কেন বাড়লো। ক্রেতারাও এর সঠিক কোনও কারণ বলতে পারছেন না। তাদের ভাষ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেখেছেন, বাজারে এ ধরনের কথা শুনেছেন। এ পরিস্থিতিকে গুজব অভিহিত করে বিসিক বলছে, দেশে লবণের কোনও ঘাটতি নেই। অসাধু ব্যবসায়ীরা ভুল তথ্য ছড়িয়ে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে।
স্টাফ রিপোর্টার, মৌলভীবাজার থেকে জানান: মুঠোফোন ও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ায় মৌলভীবাজারে লবণের দর বেড়েছে। সোমবার সন্ধ্যারাতে ছড়িয়ে পড়ে লবণের কেজি ৮০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কারণ ছাড়া হঠাৎ করে এত দাম বৃদ্ধির খবর শুনে চোখ ছানাবড়া সবার। এমনিতে পিয়াজের দামবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস। তার উপর লবণের এমন বাজার দর। এমন খবরে সবাই দিশেহারা হয়ে ছুটেন লবণ কিনতে। হুমড়ি খেয়ে ভীড় জমান মুদি দোকানে। একসঙ্গে এত লবণের চাহিদার যোগান দিতে কোন কোন ছোট দোকানিদের হিমশিম খেতে হয়। আবার অনেকেই বেশি মুনাফার আশায় নানা কৌশলেরও আশ্রয় নিতে থাকেন। হঠাৎ এমন কাণ্ডে হুলুস্থুল পড়ে যায় গ্রাম থেকে শহরে এমনকি পুরো জেলায়। এমন অবস্থায় জেলার ৭টি উপজেলায় জেলার ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে সোচ্চার হন প্রশাসনের লোকজনও।
মৌলভীবাজার শহরে পৌর মেয়র মো. ফজলুর রহমানের নির্দেশে ও পৌরসভার উদ্যোগে গুজবে কান না দিতে মধ্য রাত পর্যন্ত সর্তকতামূলক মাইকিং করা হয়। এছাড়া জেলা ও উপজেলা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অসাধু ব্যবসায়ীদের ধরতে অভিযান চালায়।
জানা গেছে, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশেকুল হক সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ধলাই নদীর নতুন ব্রিজের ওপর এক সিএনজি আটোরিকশা থেকে ৩৭৫ কেজি লবণসহ ওই উপজেলার ব্যবসায়ী আব্দুল কাদেরকে আটক করেন। পরে তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
মৌলভীবাজার জেলার পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ পিপিএম (বার) মানবজমিনকে জানান, আমরা এই খবর পাওয়ার পর জেলার সবক’টি উপজেলার পুলিশ অফিসারদের মাঠে নামাই। দ্রুত সময়েই তা কন্ট্রোল করতে সক্ষম হই। এই গুজব ছড়ানোর নেপথ্যে কারা জড়িত আমরা তা খোঁজে বের করার চেষ্ঠা চালাচ্ছি। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ভবিষ্যতেও যারা এ ধরনের মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে ফায়দা লুটতে চায় তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সর্তক দৃষ্টি থাকবে।
জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, লবণের দাম বেড়েছে এমন গুজব সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সোমবার সন্ধ্যার পর পরই জনসাধারণকে লবণের দাম বেড়েছে এমন গুজবে, আগে-ভাগে কিনতে দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ঢল নামে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে জগন্নাথপুর উপজেলা সদরের জগন্নাথপুর বাজারে অধিকাংশ দোকানেই লবণের সংকট দেখা দেয়। জনসচেতনতার জন্য রাত ১১টার দিকে গুজবে কান না দিতে জগন্নাথপুর থানা পুলিশের উদ্যোগে মাইকিং করা হয়। জগন্নাথপুর উপজেলা সদরের জগন্নাথপুর বাজারের লবণ ব্যবসায়ী সুধন্য পাল জানান, সন্ধ্যার পর থেকেই লবণের কেনার জন্য লোকজন দোকানে ভিড় করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতার ভিড় বাড়তে থাকে। জগন্নাথপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী জানান, জনসচেতনতার জন্য এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর থেকে জানান, দিনাজপুরেও হঠাৎ বেড়ে গেছে লবণের দাম। গুজবে জেলা জুড়ে লবণ নিয়ে চলছে লঙ্কাকাণ্ড। মূল্যবৃদ্ধি ও মজুত রেখে ক্রেতাকে না দেয়ায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে বাক-বিতন্ডা, সংঘর্ষ ও ভাংচুরের ঘটনাও ঘটেছে। ১৫ টাকার খোলা লবণ প্রতিকেজি ৫০ টাকা এবং প্যাকেটজাত ৩৫ টাকার লবণ এক’শ থেকে দেড়’শ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়েছে। প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি লবণ মজুত করেছে কোন কোন পরিবার। ৫ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত ক্রয় করেছে কেউ কেউ। এগুজব এড়াতে জেলা প্রশাসন মাইকে প্রচারের পাশাপাশি বাজার মনিটরিং সেল গঠন করেছে।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, পেয়াজের মূল্য বৃদ্ধির পর এবার লবণের মূল্য বেড়েছে, এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে জেলা সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাট বাজারে। এতে করে মঙ্গলবার বেশি দামে লবণ বিক্রি শুরু করে কিছু ব্যবসায়ী। লবণের দাম বৃদ্ধির গুজব ছড়ানোর অভিযোগে দুইজনকে আটক করেছে পুলিশ। ভ্রাম্যমান আদালত জরিমানা করেছে দুইজনকে। প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা সদরের বিভিন্ন বাজারে কেজিতে ৫-১০ টাকা বাড়িয়ে দেয়। ৩৫ টাকা কেজির লবণ ৬০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে দেখা গেছে।
বাউফল (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার সর্বত্র হঠাৎ করেই লবণের দাম বৃদ্ধির গুজব ছড়িয়ে পড়ায় ভিড় দেখা গেছে বিভিন্ন হাট বাজারের দোকানগুলোতে। মঙ্গলবার বেলা ১১ টার দিকে ওই গুজব ছড়িয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। কে বা কারা ফোন করে এ সব গুজব ছড়িয়েছে তা বলতে পারছেন না ক্রেতারা। দাম বৃদ্ধির আশংকায় যে যার সাধ্য মত লবণ ক্রয় করছেন। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বিক্রেতারা।
পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় লবণের দাম বৃদ্ধি ও সংকটের গুজবে লবণ কেনার ধুম পড়েছে দোকানগুলোতে। গতকাল সকাল থেকেই পাকুন্দিয়া পৌরসদর বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন বাজারের দোকানগুলোতে লবণের ক্রেতারা ভিড় করছেন। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি লবণ কিনছেন ক্রেতারা। এদিকে গুজব প্রতিরোধে ও বাজার মনিটরিংয়ে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলার সবকটি বাজারের ব্যবসায়ি নেতাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি জানান, মৌলভীবাজারে শ্রীমঙ্গলে এবার লবণ কেনার হিড়িক পড়েছে। সোমবার রাত নয়টা থেকে পাইকারি ও খুচরা দোকান গুলোতে ক্রেতারা লবণ কিনার জন্য ভিড় করছেন। রাতে শহরের পাইকারি মার্কেট সেন্ট্রাল সড়কে গিয়ে দেখা যায়- মেসার্স বিজয় কুমার দেবের দোকান থেকে মৌলভীবাজারের নিজাম উদ্দিন ৩ হাজার ৭৫০ কেজি লবণ কিনে নিচ্ছেন। এছাড়া শহরের কলেজ সড়কের রহমানিয়া ষ্টোরের মালিক জানান, সন্ধ্যার পর থেকে তিনি ১০০ কেজি লবণ বিক্রি করেছেন। মৌলভীবাজার ইসলাম স্টোরের কর্মচারী বলেন, তিনি দুই ঘন্টায় ৭৫ কেজি লবণ বিক্রি করেছেন।
কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি জানান, হঠাৎ করে লবণ শূন্য হয়ে পড়েছে কমলগঞ্জ উপজেলা সদরের ভানুগাছ বাজারসহ উপজেলর বিভিন্ন বাজারের খুচরা দোকানগুলো। লবণের দাম কেজি প্রতি একশ থেকে দেড়শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে- এমন গুজবে ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়েন লবণ কিনতে। সোমবার বিকাল থেকে লবণের গুজব ছড়ালেও সন্ধ্যার পর থেকে তা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সন্ধ্যার পর একের পর এক ক্রেতা লবন কিনতে আসা ক্রেতাদের সামাল দিতে দোকানীদের বেগ পেতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট দোকানগুলোর ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে লবণ বিক্রি বন্ধ করে দেন সন্ধ্যার পর থেকে।
সোমবার রাতে লবণ মজুদ করার অপরাধে এক ব্যবসায়ীকে জরিমানা ও লবন ভর্তি জিএনজি গাড়ি জব্দ করেছে ভ্রাম্যমান আদালত।
গুজবে হুলুস্থুল শুরু হলে বাজার মনিটরিংয়ে নামেন কমলগঞ্জ থানার ওসি আরিফুর রহমান। তাদের সঙ্গে যোগ দেন ভানুগাছ বাজার পৌর বণিক সমিতির নেতারা। অপরদিকে কমলগঞ্জের ইউএনও আশেকুল হক বের হন বাজার মনিটরিংয়ে। রাত সাড়ে ১১টায় লবণ নিয়ে মজুদ করার অপরাধে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে আদমপুর বাজারের আব্দুল কাদির নামে এক ব্যবসায়ীকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা ও ৩৭৫ কেজি লবণসহ সিএনজি গাড়ি জব্দ করা হয়। এদিকে দাম বাড়ার গুজবের মধ্যেও পূর্বনির্ধারিত ৩৫ টাকা দামেই লবন বিক্রি করেন ভানুগাছ বাজারের স্টেশন রোডের ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন।
মাধবপুর (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি: হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে লবনের দাম বৃদ্ধির গুজব ও অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রির অভিযোগে ৮ ব্যবসায়ী কে ৫১ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই সঙ্গে মূল্য তালিকা টানানোরও নির্দেশ দেয়া হয়। মঙ্গলবার মাধবপুর উপজেলা কর্মকর্তা তাসনূভা নাশতারাণ ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) আয়েশা আক্তার লবণের দাম বৃদ্ধির গুজবে উপজেলা সদরসহ ধর্মঘর, চৌমুহনী,মনতলা,হরষপুর,নয়াপাড়া, জগদীশপুর,ছাতিয়াইন ও কালিকাপুর বাজারে বিভিন্ন মুদি দোকানে মনিটরিং করেন। এসময় অতিরিক্ত মূল্যে লবণ বিক্রির অভিযোগে ৮জন ব্যবসায়ীকে নগদ ৫১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা তাসনূভা নাশতারাণ জানান, কেউ যদি গুজব ছড়িয়ে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করার অপচেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঢাকার বাজারে যে চিত্র: হাতিরপুল কাঁচাবাজারের মিল্টন স্টোরের ব্যবসায়ী মানিক বলেন, ২০০ কেজির মত লবণ ষ্টকে ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সব লবণ বিক্রি হয়ে গেছে। অন্যন্য দিন যেখানে ২৫ থেকে ৩০ কেজি লবণ বিক্রি হয়। একেক জন ক্রেতা পাঁচ কেজি থেকে শুরু করে দশ কেজি পর্যন্ত কিনে নিচ্ছে। দুপুরের পর থেকে আমার দোকানে কোনো লবন নেই। কিন্তু পরিচিত অপরিচিত অনেক ক্রেতাই এসে চাইছে। তাদের ধারণা দাম আরও বাড়বে। তিনি বলেন, ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে দাম বাড়েনি এবং বাড়বেওনা। তাই তাদের কথা মত আমরা আগের দামেই বিক্রি করেছি। একই বাজারের ইব্রাহিম স্টোরের বিক্রেতা হৃদয় বলেন, ক্রেতারা লবণ, লবণ বলে পাগল করে ফেলছে। ৫০ কেজির মত ছিল। এক ঘণ্টার মধ্যে সব বিক্রি হয়ে গেছে। পুলিশ এসে আমাদের বলে গেছে কাউকে যেন দুই কেজির ওপরে না দেই। হাতিরপুল থেকে এক ব্যক্তি ২৫ কেজি লবণ নিয়ে যাবার সময় পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে। নুরনবী নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, অন্যদিন ১ কেজি লবণ যারা একসঙ্গে কিনতে পারতো না আজ তারা ২/৩ কেজি লবণ কিনে নিয়ে গেছে। কিছু ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করেছে। তবুও মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লবণ কিনছে। প্রথমা ষ্টোরের ব্যবসায়ী মিলন বলেন, ৬০ কেজি লবণ দুই ঘণ্টার মধ্যে শেষ। তবে আমি আগের দামেই বিক্রি করেছি। পুলিশ সদস্যরা সাদা পোশাকে এসে ৫ কেজি লবণ কিনেছে। পরে আবার লবণ দিয়ে টাকা ফেরত নিয়েছে। তিনি বলেন, দাম বাড়লে সবার আগে জানবে ডিস্ট্রিবিউটররা। তারপর জানবো আমরা পরে ক্রেতারা। কিন্তু এখন দেখছি ক্রেতারা আগেই জেনে গেছে। হাতিরপুল এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এলাকার সব ছোট বড় দোকানে গেছি। একটা দোকানেও লবণ পাইনি। দুটি দোকানে পেয়েছি তবে তারা ৬০ টাকা করে দাম চায়। দাম বেশি চাওয়াতে কিনতে পারিনি। একই কথা জানালেন আব্দুল মালেক নামের আরেক ক্রেতা। তিনি বলেন, আধা ঘণ্টা ঘুরে ১ কেজি লবণ পেয়েছি। কিছু কিছু দোকানে আছে তবুও বিক্রি করছে না। চাহিদা বেশি থাকায় তারা ষ্টক করে রেখে দিচ্ছে। পরিবাগ এলাকার বাসিন্দা শাহ আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের কাছে লবণ আছে। তারা ইচ্ছে করেই না থাকার কথা বলছে। যাদের কাছ থেকে দাম বেশি পায় তাদের কাছেই বিক্রি করছে। দাম বাড়ানোর একটা ফন্দি।
হাতিরপুল বাজার সংলগ্ন গলিতে ইত্যাদি স্টোরে মেলে লবণ। বিক্রেতা প্যাকেটের গায়ের মূল্যেই বিক্রি করছেন। বিক্রেতা খোকন ইসলাম বলেন, হাফ কেজির লবণ ২০ টাকা এবং ১ কেজি লবণ ৩৫ টাকায় বিক্রি করছি। আমার দোকানে ২০ কেজির মতো লবণ ছিলো। এখন আছে ৫/৬ কেজি। পরিচয় গোপন করে কাঠাল বাগানের পুুকুরপাড় গলির গাজী জেনারেল স্টোরে গেলে বিক্রেতা প্রতি কেজি লবণের দাম ৫০ টাকা চান। ৩৫ টাকা কেজির লবন কেন তিনি ১৫ টাকা বেশি রাখছেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দাম বেশি রাখতেছি তাই সবাই নিচ্ছে না এজন্যইতো এখনো লবণ পাইতেছেন। অন্য দোকানের মতো দাম রাখলে এতক্ষণে সব লবণ বিক্রি হয়ে যেতো। দুপুরে ৬০ টাকা করে বিক্রি করেছি। এখন তাও ১০ টাকা কম রাখছি। একই গলির আরো বেশ কিছু দোকানে লবণ চাইলেও দিতে পারেননি কেউ। কয়েকটি দোকানে অনুরোধ করে এমনকি অধিক মূল্য দিতে চাইলেও স্টক শেষ বলে জানানো হয়।
কাঠালবাগান এলাকার বাসিন্দা মো. আরমান হোসেন বলেন, দুপুর বেলা খাবার খেতে হোটেলে আসলে লবণের ঘাটতির কথা শুনি। সঙ্গে সঙ্গে লবণ কিনতে যাই। ২ কেজি লবণ কিনি ১২০ টাকায়। পান দোকানি মিজানুর রহমান বলেন, আধা কেজির ২টি লবণের প্যাকেট কিনেছেন ৮০ টাকায়। ফ্রি স্ট্রিট স্কুল এলাকার শাহ আলম নামের এক বাসিন্দা বলেন, পিয়াজের মূল্য হঠাৎ করেই আকাশচুম্বী হওয়ায় মানুষের মনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এরপর চালের দাম বৃদ্ধিটাও প্রভাব ফেলেছে সকলের মনে। এ কারণেই লবণের ঘাটতির গুজবটি জনসাধারণের কানে যেতেই হুমড়ি খেয়ে লবণের দিকে ছুটেছেন ক্রেতারা। কাওরান বাজারের শিমুল স্টোরের মালিক শিমুল হাসান বলেন, আমি প্রায় ১শ কেজি’র মতো লবণ বিক্রি করেছি। এখানে যতদিন ধরে ব্যবসা করছি একদিনে এত লবণ কখনো বিক্রি করিনি।
আরেক দোকানি জেনারেল স্টোরের মালিক সায়েম বাবুল বলেন, সকাল থেকেই লবণ বিক্রি বেশি ছিলো। তবে বিকাল থেকে আর বিক্রি হয়নি। দিনভর লবণ কেনার জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো। একই বাজারের ব্যবসায়ী সুমন জানান, দাম প্রায় সময় ওঠানামা করেছে। কখনো বেশি আবার কখনো কম। এভাবেই সারাদিন বিক্রি হয়েছে লবণ। কাওরান বাজার, তেজতুরি বাজার গলি, তেজকুনি পাড়া ঘুরে দেখা গেছে অধিকাংশ দোকানেই লবণ নেই। থাকলেও দাম রাখা হচ্ছে চড়া। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলেও কাওরান বাজারের মুদি দোকানগুলো ছিল খোলা। বেসরকারি চাকরিজীবি ক্রেতা জাকারিয়া বলেন, হঠাৎ শুনি লবণের দাম ১২০ টাকা। এটা শুনেই দৌড়ে কাওরান বাজার চলে আসি। তিন কেজি লবণ নিয়েছি। কেউ বলছে দাম বেশি। কেউ বলছে লবণ নাই। ক্রেতা বাদল বলেন, বাসায় লবণ নেই এজন্য এসেছি। এসে শুনি লবণ নিয়ে লঙ্কা কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে ২০ টাকা দিয়ে আধা কেজি নিয়েছি।
সবার ভেতরে একটি আতঙ্ক। আসলে কিছুই না। কাওরান বাজারের আনসার মাঝি স্টোরের দোকানি মো. সাগর বলেন, আমার দোকানে সকালেই সব লবণ বিক্রি হয়ে গেছে। আগের দামেই বিক্রি করেছি। তেজকুনি পাড়া গলির মায়ের দোয়া স্টোরের দোকানদার বাবলু বলেন, দুপুর ১২টার সময় লবণ শেষ হয়েছে। আগের দামেই বিক্রি করেছি। যাদের এক কেজি দরকার তারা পাঁচ কেজি নিয়েছে। দাম বাড়েনি। শুধু শুধু মানুষ ভূয়া গুজব ছড়িয়েছে। আরেক দোকানি মো. তোফায়েল আহমেদ বলেন, লবণের দাম বেড়েছে আপনারা কিনতে এসেছেন তাই। মানুষ বেশি দেখলে আমরা দোকানদাররা তো লাভ করতে চাইবো। নূর জেনারেল স্টোরের দোকানদার মিজানুর রহমান বলেন, লবণের দাম আগেরটাই আছে। তবে এখন শেষ। এদিকে পশ্চিম তেজতুরি বাজার গলি ঘুরে দেখা গেছে মাত্র দুটি দোকানে লবণ ছিল। বাকী দোকনগুলোতে সকালের মধ্যেই লবণ বিক্রি হয়ে গেছে। মা জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা বলেন, আছে তবে দাম একটু বেশি। আধা কেজির প্যাকেট ৩৫ টাকা। কেজি ৭০ টাকা। হঠাৎ করে দাম বেড়ে গেছে। মার্কেটে লবণ নাই। ইতোমধ্যে এলাকার অনেকেই লবণ বুকিং দিয়ে গেছে। যেগুলো আছে সেটা বিক্রি করা যাবে না। সব বুকিং হয়ে গেছে।