প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায় বাড়ছে পিয়াজের দাম। ত্রিশ টাকা কেজির পিয়াজের দাম উঠেছে ২৬০ টাকা। সামনে আর কতো বাড়বে এরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। পিয়াজের বোমফাটা এই দামে জেরবার মানুষ। অতি প্রয়োজনীয় এ পণ্যের ব্যবহার অনেকে কমিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে দামে পিষ্ট অসহায় মানুষকে জিম্মি করে শ’ শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট। সরকারের নানা আশ্বাস থাকলেও এ পর্যন্ত কোন সুফল মিলছে না। সামনে কার্গো বিমানে পিয়াজ আসছে, এতে দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে সর্বশেষ এমনটা বলা হয়েছে সরকারের তরফে।
শনিবারও প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৬০ থেকে ২৬৫ টাকায়। যা একদিন আগে ছিল ২৫০ টাকা। মোকাম থেকে প্রতি কেজি ১৩৭ টাকা দরে কেনা পিয়াজ ২২০ টাকায় বিক্রি করছেন আড়তদার ও মজুতদাররা। পাইকারিতেই কেজিতে লাভ ৮৩ টাকা। এভাবে এক দিনেই সিন্ডিকেটের পকেটে যাচ্ছে শত শত কোটি টাকা। হাতিয়ে নিচ্ছে ভোক্তার অর্থ। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেয়া হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। বাণিজ্যমন্ত্রী ‘নিয়ন্ত্রণে’র কথা বললেও আমদানির ঘোষণা, অভিযান, কিছুই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। টিসিবির হিসাবেই বছরের ব্যবধানে পিয়াজের দাম বৃদ্ধির হার ৫৪৬.১৫ শতাংশ।
এদিকে ক্রমাগত দামের ঊর্ধ্বগতিতে পিয়াজ কেনা ও ভোগের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছেন ভোক্তারা। ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে চরম চাপে পড়েছে সীমিত আয়ের মানুষ। আর কত বাড়বে পিয়াজের দাম? এ প্রশ্ন এখন তাদের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পিয়াজের সরবরাহ কম। তাই দাম বাড়ছে। রাজধানীর কাওরান বাজার, শ্যামবাজার ও বেশকয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অনেক খুচরা বিক্রেতা দু’তিন দিন আগে পিয়াজ কিনলেও সকালে বাজার দেখে ও পত্রিকা, টিভি দেখে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। কাওরান বাজারের পাইকারি বাজারে দেশি পিয়াজ ২২০ থেকে ২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই পিয়াজ খুচরা বাজারে ২৬০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। মিয়ানমার ও মিশরের পিয়াজও ১৯০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে দেশি পিয়াজের কেজি ১৪০ টাকায় উঠেছিল। সেটাই ছিল এযাবৎকালের সর্বোচ্চ দর।
কাওরান বাজারের পিয়াজের পাইকারি বিক্রেতা মজিদ বলেন, বাজারে এখন দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২২৪ টাকায়, মিশর ১৯০ টাকা ও মিয়ানমারের পিয়াজ ২২০ টাকায়। খান অ্যান্ড সন্স বাণিজ্যালয়ের মালিক গৌতম বাবু বলেন, পাইকারি বাজারে গত দুই দিনই পিয়াজের দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহেরও কম সময়ের ব্যবধানে পাইকারি বাজারেই কেজিতে পিয়াজের দাম বেড়েছে অন্তত ৮০ টাকা।
শ্যামবাজারের ছোট আড়তদারদের চিত্র আরো ভয়াবহ। এক পাল্লার (৫ কেজি) নিচে পিয়াজ বিক্রিই বন্ধ হয়ে গেছে। আর এক পাল্লা দেশি পিয়াজের দাম পড়ছে ১২০০ টাকা থেকে ১২৫০ টাকা, অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। সেই দেশি পিয়াজ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকা কেজিতে।
শ্যামবাজার বণিক সমিতির সহ সভাপতি হাজী মো. মাজেদ বলেন, বাজারে দেশি পিয়াজ এখন ২০০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিয়ানমার ও মিশরের পিয়াজ ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়। তিনি বলেন, শ্যামবাজার এখন পিয়াজ শূন্য। বাজারে পিয়াজ নেই। হঠাৎ পিয়াজের বাজার এমন আকাশচুম্বি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাজারে পিয়াজ নেই।
এদিকে একেক বাজারে একেক রকম দাম লক্ষ্য করা গেছে। আবার ঢাকার বিভিন্ন অলি-গলি ও মহল্লার দোকানে খুচরা বাজারের চেয়ে আরো বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে পিয়াজ।
মহাখালীর বউবাজারে দেশি পিয়াজ ২৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। মিশরের পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। এই বাজারের পিয়াজের বিক্রেতা আমিনুল ইসলাম বলেন, আগের কেনা থাকায় আমরা ২৫০ টাকায় বিক্রি করছি। কোনো কোনো দোকানে দাম আরো বেশি। মগবাজারের মধুবাগ বাজারটিতেও ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা কেজিতে দেশি পিয়াজ বিক্রি হতে দেখা গেছে।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর উত্তর রায়েরবাগ বাইতুত তাকওয়া জামে মসজিদ বাজার এলাকার কবির জেনারেল স্টোরের দোকানি শরিফুল জানান, দেশি পিয়াজের কেজি ২৭০ টাকা আর মিয়ানমারের পিয়াজ ২৫০ টাকা। তিনি বলেন, দেখেন দুপুরের পর কী হয়? সন্ধ্যার মধ্যে কেজি ৩০০ টাকাও হইয়া যাইতে পারে।
একই বাজারের ব্যবসায়ী বাবুল হোসেন বলেন, আমি সবচেয়ে ভালো দেশি পিয়াজ ২৫০ টাকাই বিক্রি করছি। পিয়াজটা আমার আগের কেনা। শুনছি আড়তে আজকেও (গতকাল) পিয়াজের দাম বেড়েছে। বেশি দামে কিনে আনলে আমাকেও বেশি দামে বিক্রি করতে হবে।
যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভালো মানের দেশি পিয়াজ ২৬০ টাকা এবং একটু নিম্নমানের ও আমদানি করা পিয়াজ ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
পিয়াজের খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিনই দাম বাড়ার কারণে মানুষ পিয়াজ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। আগে মোটামুটি সামর্থ্যবান যারা ছিলেন, তারা ৫ কেজির (এক পাল্লা) নিচে পিয়াজ কিনতেন না। কিন্তু এখন তারা এক কেজির বেশি কেনেন না। আর একপোয়া (২৫০ গ্রাম) পরিমাণ পিয়াজ বিক্রির হার অনেক বেড়ে গেছে।
পলাশি কাঁচাবাজারের খুচরা বিক্রেতা বলেন, পিয়াজের দামের ঊর্ধ্বগতি এতটাই হয়েছে যে এক বস্তা পিয়াজের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার টাকায়।
বিক্রেতা হোসেন আলী বলেন, গত কয়েক সপ্তাহে একসঙ্গে এক কেজির বেশি পিয়াজ কিনেছেন এমন ক্রেতা পাইনি। মানুষ পিয়াজ খাওয়া অনেক কামিয়ে দিয়েছে। অনেকে ১০/২০ টাকারও পিয়াজ চায় এখন, বিক্রিও করি। আগে এমন ছিল না।
ক্রেতা মো. ইসমাইল বলেন, সকাল-বিকাল পিয়াজের দাম বাড়ে, এটা কেমন দেশ? মনে হয় কেউ দেখার নেই। কিছু তো করতে পারব না তাই পিয়াজ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। ৫০০ গ্রাম পিয়াজ দিয়ে ১০ দিন খাচ্ছি। আগে যেখানে মাসে লাগতো ৬ কেজি পিয়াজ।
সেগুন বাগিচা বাজারে পিয়াজ কিনতে এসেছিলেন দিলারা বেগম। তিনি বলেন, গতকাল খবরে দেখলাম, পিয়াজ ১৫০ টাকা। রাত পোহাতেই সেই পিয়াজ কিভাবে ২৬০ টাকা হয়ে যায়, মাথায় খেলছে না।
এদিকে কাওরান বাজারে পাতাসহ নতুন পিয়াজও উঠেছে। এককেজি পাতাসহ পিয়াজের দাম পড়ছে ১৫০ টাকা। পিয়াজের দাম শুনে অনেকে এই কাঁচা পিয়াজও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিবিসি) পিয়াজের বাজার দর উল্লেখ করেছে, প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা। এরমধ্যে আমদানি করা প্রতি কেজি পিয়াজ ২১০ থেকে ২২০ টাকা এবং দেশি পিয়াজ প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। টিসিবির হিসাবেই বছরের ব্যবধানে দাম বৃদ্ধির হার ৫৪৬.১৫ ভাগ।
এদিকে গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসে পিয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার পর খোলা বাজারে পিয়াজ বিক্রি শুরু করে সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবি। সর্বশেষ প্রতিদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ৩৫টি ট্রাক বসিয়ে প্রতি কেজি ৪৫ টাকা দরে পিয়াজ বিক্রি করছিল তারা। একজন ক্রেতা এক কেজি করে পিয়াজ কিনতে পারছিলেন। আর ট্রাক সেলের ডিলার পাচ্ছিলেন প্রতি দিন এক টন করে পিয়াজ। অর্থাৎ দিনে একটি ট্রাক থেকে প্রায় ১ হাজার পরিবারের পিয়াজের চাহিদা পূরণ হচ্ছিল।
এদিকে গতকাল রাজধানীর সবচেয়ে বড় পিয়াজের আড়ত পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল। অভিযানে অভিনব কায়দায় মুনাফা করার পদ্ধতি দেখে অবাক হন আব্দুল জব্বার।
অভিযান চলাকালে মেসার্স রিতা মুক্তা বাণিজ্যালয়ে পিয়াজের ক্রয় রসিদ দেখতে চাওয়া হয়। রসিদে ক্রয় মূল্য লেখা ১৩৭ টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করছে ২২০ টাকা। অর্থাৎ পাইকারিতে কেজিতে লাভ করছে ৮৩ টাকা, যা দেখে অবাক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার তদারকি টিম।
আব্দুল জব্বার বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ক্রয় রসিদের তথ্য অনুযায়ী, ১৩ই নভেম্বর ১৩৭ টাকা কেজি এবং ১৪ই নভেম্বর ১৫৫ টাকা কেজি মূল্যে ক্রয় করে স্টক করেছে, সেই পিয়াজ আজ (গতকাল) বিক্রয় করছেন কেজি ২২৯ টাকা। ১৩৭ টাকায় কেনা পিয়াজের ক্রয় মূল্যের সঙ্গে খরচ পরিবহন ভাড়া যোগ করলে সর্বোচ্চ মূল্য ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা হবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ২২০ টাকা বিক্রি করছে। এটা কীভাবে সম্ভব? অর্থাৎ ক্রাইসিস তৈরি করে তারা অনৈতিকভাবে দাম বাড়িয়েছে যেটা যুক্তিযুক্ত কোনো কারণ হতে পারে না। এরা মজুত করে পিয়াজের মূল্য বাড়াচ্ছে। আসলে তারা জনগণকে জিম্মি করে বাড়তি মূল্য আদায় করছে। এ অপরাধে প্রতিষ্ঠানটিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান মেসার্স রিতা মুক্তা বাণিজ্যালয়ের বিক্রেতা জুলহাস মীর জানান, আগের রসিদ দেখে জরিমানা করা হয়েছে। আগে কম কেনা হলেও এখন কিনতে হয়েছে ২১০ টাকা দরে। পিয়াজ বিক্রি করে লাভ নেই উল্টো লস হচ্ছে বলে জানান তিনি। আব্দুল জব্বার মণ্ডল জানান, পিয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ীরা অভিনব কায়দায় দাম বেশি নিচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠান দাম লিখে রেখেছে ২১০ টাকা। কিন্তু বিক্রি করছে ২২৫ ও ২৩০ টাকায়। তাদের পিয়াজ কেনা ১৮০ টাকা। তার মানে অনিয়মের কারণে বেশি দাম বাড়ছে।
অভিযান চলাকালে পিয়াজের মূল্য তালিকা না টানিয়ে মূল্য বৃদ্ধিতে কারসাজি করা, প্রদর্শিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে পিয়াজ বিক্রির অপরাধে ৫ প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সূত্র জানায়, ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় গত ২৯শে সেপ্টেম্বর থেকেই দেশের পিয়াজের বাজার অস্থির। এরপর থেকে দফায় দফায় বাড়তে থাকে পিয়াজের দাম। এরপর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক বক্তৃতায় বলেন, পিয়াজের কেজি ১০০ টাকার নিচে নামা সম্ভব নয়।
মন্ত্রীর এই বক্তব্য পিয়াজের দাম বাড়ার বিষয়টিকে আরো উসকে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ১০০ টাকা থেকে পিয়াজের কেজি ১৩০ টাকায় পৌঁছে যায়। এ পরিস্থিতিতে শিল্পমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, পিয়াজের দাম স্বাভাবিক আছে পরের দিন ওই পিয়াজের কেজি ১৫০ টাকায় পৌঁছে যায়। তবে এখানেই থেমে থাকেনি পিয়াজের দাম বাড়ার প্রবণতা। বুধবার ১৫০ টাকা থেকে পিয়াজের দাম এক লাফে ১৭০ টাকা হয়। বৃহস্পতিবার সেই দাম আরো বেড়ে ২০০ টাকায় পৌঁছে যায়। আর গতকাল তা আরো বেড়ে ২৬০ টাকায় পৌঁছেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পিয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৪ লাখ টন। চলতি বছর দেশে উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ টনের মত। কিন্তু পঁচে যাওয়াসহ নানা কারণে ৮-১০ লাখ টন পিয়াজ নষ্ট হয়েছে। সেই ঘাটতি পূরণে প্রতিবছরই ৭ থেকে ১১ লাখ টন পিয়াজ আমদানি করা হয়, যার সিংহভাগই আসে ভারত থেকে।