ঢাকা: পঁচিশ থেকে ত্রিশ টাকা কেজির পিয়াজের দাম যখন শতক পেরোয় তখন থেকেই ক্রেতাদের হাপিত্যেশ বাজারে। দামের পাগলা ঘোড়া যেন এখন আরো ক্ষ্যাপাটে রূপে হাজির হয়েছে। দেড় শতকের পর ডাবল সেঞ্চুরি। সর্বশেষ গতকাল যোগ হয়েছে আরো ২০ টাকা। ২২০ টাকা ছাড়িয়েও থামেনি দাম। দাম আর কতো বাড়বে এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না। বরং সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রীর পক্ষে শিল্পমন্ত্রী যেদিন বললেন বাজার নিয়ন্ত্রণে তার পর দিনই এক লাফে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে যায় কেজিতে। অবশ্য পরিস্থিতি যে এমনটা হবে তা অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন গোয়েন্দারা।
সেই বার্তা আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হলে পরিস্থিতি হয়তো এতোটা ভয়াবহ হতো না। গতকাল সংসদে পিয়াজের দাম নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদ সদস্যরা। তারাও বলছেন, পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া হলে এমনটা হতো না। এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের সরকারের তরফে সহযোগিতা করতে হবে। প্রয়োজনে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পিয়াজ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই টানাহেচড়া চলছে। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমার, মিশর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির কথা বলা হচ্ছে তখন থেকে। পিয়াজও আসছে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না কেন এ প্রশ্নের জবাব নেই কারও কাছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা একেক সময় একেক কথা বলছেন, এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা আস্কারা পেয়ে দাম বাড়াচ্ছেন।
গত বুধবারই ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় পিয়াজ। এর পর এক লাফে ডাবল সেঞ্চুরি করে এই নিত্যপণ্যটি। গতকাল কোনো কোনো খুচরা বাজারে দাম ২২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে, যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এটি এখন পর্যন্ত স্মরণকালের সর্বোচ্চ দাম। কয়েক মাস আগেও ছিল কেজিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা। সরকারের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, বছরের ব্যবধানে পিয়াজের গড় দাম বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার পর বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবি ঢাকায় খোলা ট্রাকে ৪৫ টাকা কেজিতে পিয়াজ বিক্রি শুরু করলেও সরবারহ না থাকায় তাতে ভাটা পড়েছে। পিয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে মন্ত্রীরা বার বার আশ্বাস দিলেও এনিয়ে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়েনি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগের মতো সিন্ডিকেট করে ফের পিয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। দাম বাড়ার পিছনে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে। মিয়ানমার থেকে যেই পিয়াজ আমদানি হচ্ছে ৪২ টাকায়, ভোক্তা পর্যায়ে তা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা কেজিতে। দামের এই কারসাজিতে আমাদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্ট ও আড়তদাররা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, ভারত গত ২৯শে অক্টোবর থেকে পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এরপর বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও পিয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। রপ্তানি বন্ধের আগের দিনও বাজারে পিয়াজের কেজি ছিলো ৮০ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, আমদানিকৃত পণ্য খালাস না হওয়ায় বাজারে পিয়াজের সরবরাহ কমেছে। ফলে পণ্যটির দাম ফের বাড়তির দিকে। এদিকে দাম বেশি থাকায় পাইকারি বাজারগুলোতে পিয়াজের সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ, বিক্রেতারা বাড়তি দামে বাজারে পিয়াজ তুলছেন না।
এদিকে সরকারের নিয়মিত মনিটরিং না থাকায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমত পিয়াজের দাম বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ করেন ক্রেতারা। পিয়াজের এমন লাগামহীন দামে ক্রেতাদের মাঝে ক্ষোভ দেখা গেছে। বাজার কারা নিয়ন্ত্রণ করছেন সে প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে স্বল্পআয়ের মানুষ। আর কত বাড়বে পিয়াজের দাম? এমন প্রশ্ন এখন সাধারণ ভোক্তাদের। অতিরিক্ত দামের কারণে পিয়াজ ছাড়াই বাজার সারছেন অনেকে। যারা আগে বাজারে গিয়ে দুই কেজি পিয়াজ কিনতেন তারা এখন কিনছেন ৫০০ গ্রাম।
অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ভারত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলেও দাম এতটা বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। কারণ বর্তমানে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণ পিয়াজ দেশে রয়েছে। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতবছর থেকে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ পিয়াজ দেশে আছে তা চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। তাহলে এভাবে লাগামহীনভাবে পিয়াজের দাম বাড়ছে কেন? এর কোনো জবাব নেই।
গত সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অস্থির হয়ে উঠে পিয়াজের বাজার। ২৯শে সেপ্টেম্বর পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে ভারত। তখন দুই দিনের মধ্যে কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়ায় দেশি পিয়াজের দাম। ভারতীয় পিয়াজও বিক্রি হতে থাকে ১০০ টাকার কাছাকাছি দরে। অবশ্য বাজার তদারকির পর দাম কিছুটা কমে। তবে গত কয়েক দিন ধরে আবার লাগামহীন হয়ে পড়েছে পিয়াজের দাম।
টিসিবি’র মূল্য তালিকায় দেখা গেছে, রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজের দাম গত সপ্তাহেও ছিল ১১৫ থেকে ১২৫ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা। আর এক বছর আগে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যাবধানে কেজিপ্রতি পিয়াজের দাম বেড়েছে ৩৪০ শতাংশ।
এদিকে আমদানি করা পিয়াজের দাম গত সপ্তাহে ছিল ১০৫ থেকে ১২০ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা। আর এক বছর আগে ছিল ২৫ থেকে ৩৫ টাকা। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যাবধানে কেজিপ্রতি পিয়াজের দাম বেড়েছে ৪১৬.৬৭ শতাংশ।
গতকাল কাওরান বাজার আড়তে দেখা গেছে, এক পাল্লা (৫ কেজি) পিয়াজ ১০০০ টাকা দর হাঁকছেন বিক্রেতারা। দাম কেন বেড়েছে? জবাবে বিক্রেতা মামুন আকন্দ জানান, বাজারে ভারতীয় পিয়াজ নেই। দেশি পিয়াজের মজুতও প্রায় শেষ। তার ওপর ঘূর্ণিঝড়ে পিয়াজ পরিবহনে বিঘ্ন ঘটায় বাজারে সরবরাহ কমে গেছে। তাই দাম বেড়েছে। এই বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভালো মানের দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১ কেজি ২০০ টাকা দরে। অপেক্ষাকৃত খারাপ মানের ছোট পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা দরে। আমদানি করা পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে থেকে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে। এই বাজারে মিসর থেকে আমদানি করা পিয়াজ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা, মিয়ানমারের পিয়াজ ১৬০ থেকে ১৭০ আর দেশি পিয়াজের দাম ২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে খুচরা বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়। বিক্রেতাদের দাবি, বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলেই বেশি দামে পিয়াজ বিক্রি করছেন তারা।
সেগুনবাগিচা বাজারে ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন ক্রেতারা। আমদানি করা পিয়াজ বিক্রি করছেন ১৫০ থেকে ১৯০ টাকা দরে। মগবাজার মধুবাগ কাঁচাবাজারেও একই দাম লক্ষ্য করা গেছে।
সেগুনবাগিচার বাসিন্দা লায়লা জামান বলেন, বাড়িতে কোনো পিয়াজ নেই। পিয়াজ কিনতে বাসার পাশের দোকানে গিয়ে শোনেন এক কেজি পিয়াজ ১৯০ টাকা। পরে এক কেজি পিয়াজ কিনে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।
আরেক ক্রেতা বলেন, সকালে ১৭০ টাকা দিয়ে এক কেজি পিয়াজ কিনেছিলাম। দাম বাড়বে শুনে আবার ওই দোকানে যাই, দোকানি বলে ১ কেজি এখন ১৯০ টাকা। এই হচ্ছে অবস্থা।
রামপুরা বাজারে পিয়াজের দাম ২০০ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানালেন ক্রেতারা। আমিন রহমান নামে এক ক্রেতা জানান, বেলা ১টার দিকে ২২০ টাকা কেজি দরে পিয়াজ কিনেছেন তিনি।
হাতিরপুল কাঁচাবাজারের দেখা গেছে, কেজি প্রতি বেড়েছে প্রায় ২০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত। একদিন আগেও খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশি পিয়াজ ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা পর্যন্ত। গত সপ্তাহে ১১০ টাকা দরে বিক্রি হয় দেশি পিয়াজ।
পিয়াজ বিক্রেতা মো. মাসুম ও জাকির জানান, দেশি পিয়াজ ২১০ টাকা, মিসরীয় পিয়াজ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা এবং তুরস্ক থেকে আনা পিয়াজ ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তারা বলেন, দাম বাড়াতে বিক্রিও কমে গেছে। দাম শুনেই ক্রেতারা পিয়াজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ কিনলেও অল্প করে নিচ্ছেন। আমাদেরতো কিছু করার নেই।
পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতা আবদুল মাজেদ বলেন, চাহিদার বিপরীতে জোগান একদম কম। দেশি পিয়াজ এখনো ওঠেনি। ভারতীয় পিয়াজের আমদানি নেই। সব মিলিয়ে অস্থির বাজার। কেবল রাজধানী নয়, বাইরেও পিয়াজের বাজারে আগুন।
গত মঙ্গলবার সংসদে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ুন বলেন, শিগগিরই পিয়াজের মূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আসবে উপজেলা পর্যায় বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখন লিন সিজন (পিয়াজের মৌসুম শুরু হওয়ার আগমুহূর্ত) চলছে। এ সময় একটা সংকট থাকে। আমাদের নতুন পিয়াজ এখনো ওঠেনি। কিছুদিনের মধ্যে নতুন পিয়াজ উঠবে। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় মিয়ানমার ও তুরস্ক থেকে পিয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভারত থেকেও আমদানি চালু হয়েছে। পিয়াজের বাজার যেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিলে, সেটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু আছে, কোথাও কেউ যেন বেশি দামে বিক্রি করতে না পারে। তবে এই আশ্বাসের পরও ঝাঁজ বেড়েছে পিয়াজের দামে।