ঢাকা: রাঙ্গা ও রঙিন অনেকটাই কাছাকাছি দুটি শব্দ। রাঙ্গা শব্দের বিশেষণ পদ হল রক্তবর্ণ। আর রাঙা শব্দের বিশেষণ পদ হল নানা রঙে শোভিত। কবি অমিতাভ শূর তার লজ্জাবতী কবিতায় লিখেছেন,
লাজুক লতা লজ্জাবতী
তার লাজের সীমা নাই
একটু ছুঁলেই থির থিরিয়ে
লাজে মরে যায়
কবিরা যা বলেন তা বাস্তবতার নিরিখেই বলেন। আজকের কবিতা যা আজকের ও আগামীর পাথেয়। ইতিহাস বলে, যে কবি মাধ্যমিক অতিক্রম করতে পারেনি, তার লেখা উচ্চা শিক্ষার পাঠক্রমও বটে। সুতরাং বলা যায়, কবিদের মেধা অলৌকিক অনেকটাই।
এই সময়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় চলছে। কিছু দিন আগে রাশেদ খান মেননের বক্তব্য নিয়েও তোলপাড় ছিল। তবে দুই জনই তোলপাড় করা বক্তব্যের পর পরই দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
মেনন সাহেব বলেছিলেন, আমি ও প্রধানমন্ত্রীসহ যারা নির্বাচিত হয়েছি আমাদেরকে দেশের কোনো জনগণ ভোট দেয় নাই। কারণ ভোটাররা কেউ ভোটকেন্দ্রে আসতে পারে নাই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি।
রাঙ্গা সাহেব বলেছেন, ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কাকে হত্যা করলেন। নূর হোসেনকে? নূর হোসেন কে? একটা অ্যাডিকটেড ছেলে। একটা ইয়াবাখোর, ফেনসিডিলখোর।’ তাঁর দাবি, নূর হোসেনের হত্যার ঘটনায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ বা তাঁর সরকার দায়ী ছিল না। যে ধরনের গুলিতে নূর হোসেন মারা গেছেন, সে ধরনের গুলিও তখন পুলিশ ব্যবহার করত না।
গণতন্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের অবস্থানের সমালোচনা করেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, এই দুই দলের গণতন্ত্র হলো ফেনসিডিলখোর, ইয়াবাখোর, যারা ক্যাসিনোর ব্যবসা করে তাদের নিয়ে। এরাই হলো দুই দলের কাছে গণতন্ত্রের সোনার সন্তান। জাপা মহাসচিব বলেন, সরকার রাজনীতিবিদেরা কী করছে তা দেখে, কিন্তু ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যে সম্রাট তাকে এই সরকার, পুলিশ, প্রশাসন কেউ এত দিন দেখেনি। কেননা এই সরকার মনে করে সম্রাটরা যা করে, গণতান্ত্রিক ভাবে করে। রাঙ্গা বলেন, এখন সোনার ছেলেদের ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির ইতিহাস বের হচ্ছে। কিন্তু এত দিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সোনার ছেলেদের দেখেনি, তাদের দৃষ্টি ছিল শুধু রাজনৈতিক নেতাদের দিকে।
রাঙ্গা বলেন, এইচ এম এরশাদই এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কথা ছিল তাঁকে জেলে নেওয়া হবে না। কিন্তু বিচারপতি ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবউদ্দিন আহমেদ তা মানেননি।
জাপা নেতা বলেন, নূর হোসেনের মৃত্যু নিয়ে এত হইচই হলো। কিন্তু এখন এমন একটা দিন নেই যেদিন খুন হচ্ছে না। হাজার হাজার খুন হচ্ছে। বিশ্বজিৎ, আবরার খুন হয়েছেন। নারীরা একজন আরেকজনকে কোপাচ্ছেন।
এই বক্তব্যের পর ক্ষমা চেয়ে রাঙা সাহেব একটি পত্রিকাকে বলেছেন, ‘আমি গতকাল বলেছিলাম, নূর হোসেন মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল, ইয়াবাখোর, ফেনসিডিলখোর ছিল। সেটা আমার স্লিপ অব টাং হয়ে গিয়েছিল। আমি স্বীকার করছি, তখন ফেনসিডিল-ইয়াবা পাওয়া যেতো না। সুতরাং এই দুটি শব্দের জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি।’
নূর হোসেনের বুকেপিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখা প্রসঙ্গে রাঙ্গা বলেন, এসব কথা তো আপনি আপনার বুকে আঁকতে বা লিখতে পারেন না। কেউ না কেউ এটা লিখে দিয়েছে। একজন সুস্থ প্রকৃতির মানুষ এটি কোনও সময় করতে পারেন না। সে মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। এটা কেউ না কেউ সাবোটাজ করেছে। একটা লাশের দরকার ছিল। সেটা তারা করেছে। একইভাবে আমরা ডাক্তার মিলন হত্যারও প্রতিবাদ করেছি। তাকেও পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে। এগুলো হলো রাজনীতির আলোচনা।
এখন প্রশ্ন হল, মেনন ও রাঙ্গা কেন এসব কথা বলেছেন। আবার কেনই বা ক্ষমা চাইছেন। অপরাধ করার পর ক্ষমা চাওয়া যায়। তবে অপরাধের ধরণ প্রকৃতি অনেক সময় ক্ষমাকে অর্থহীন করে দেয়। মেনন সাহেব যা বলেছেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। কারণ তিনি নিজে যে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করেছেন সেই নির্বাচনকে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। যদি তিনি আদর্শবান নেতা হতেন তবে তিনি শপথ গ্রহনই করতেন না। তাই শপথ গ্রহন করে সংসদে যোগ দিয়ে নিজের নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা অনৈতিক।
এদিকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব যে বক্তব্য দিয়েছেন তা যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নূর হোসেনকে নিয়ে তিনি যা বলেছেন, তা গনতন্ত্রের সঙ্গে প্রতারণা ও হাসিতামাশার সামিল। কারণ রাঙ্গার দল জাতীয় পার্টি ৯ বছর দেশ শাসন করেছে সম্পূর্ন স্বৈরাচারীভাবে। নূর হোসেনদের রক্তের বিনিময়ে রাঙঙ্গাদের হাত থেকে দেশ মুক্ত হয়। এবং পরবর্তি সময় সকল দলের অংশ গ্রহনে গ্রহনযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নিঃসন্দেহে রাঙ্গাদের সরকার ছিল স্বৈরাচারী সরকার।
তবে রাঙ্গার এই বক্তব্য আমাদের অর্জন বললে ভুল হবে না। কারণ, যে স্বৈরাচারকে উৎখাত করতে নূর হোসেনরা শহীদ হয়েছেন, সেই স্বৈরাচারকে সঙ্গে নিয়ে সরকার পরিচালনা হচ্ছে। ওই স্বৈরাচারী দল গণতান্ত্রিক সরকারের অংশ হয়ে দেশ শাসন করেছে। এমনকি ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশ গ্রহনকারী একাধিক দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় এসেছে স্বৈরাচারী এরশাদের দল।
দুঃখজনক ঘটনা হল, আজকে যে দলের মহাসচিব হিসেবে রাঙ্গা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনকে নতুনভাবে আবার হত্যা করলেন, সেই রাঙ্গার দলের প্রধান এরশাদ, সরকার প্রধানের বিশেষ দূতের দায়িত্বও পালন করেছেন মন্ত্রীর পদমর্যদায়। যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন রাঙ্গাদের দল, সেই আন্দোলনের অংশীদার দলের সঙ্গে সরকারও পরিচালনা করছেন রাঙ্গারা। রাঙ্গারা মনে করেন, তাদের ছাড়া সরকার পরিচালনা সম্ভব নয়। আর এই ধারণা থেকেই রাঙ্গার এমন ঔদ্ধত্য আচরণ।
রাঙ্গার এই বক্তব্যে শহীদ নূর হোসেন ও মিলনদের আবারো হত্যা করা হয়েছে এটা পরিস্কার। এই প্রক্রিয়ায় শহীদদের যদি হত্যা করার সংস্কৃতি চালু হয়, তবে রাজপথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দেশপ্রেমিক নূর হোসেনদের দল শূন্য হয়ে পড়তে পারে। এটা এক ধরণের দল শুন্য করার হুমকি। তাই রাঙ্গার ক্ষমা চাওয়াকে আমলে না নিয়ে বিচার করা উচিত। না হলে, ভবিষৎ বিপদ আরো বাড়বে, এটা পরিস্কার।
পরিশেষে বলা যায়, মেনন ও রাঙ্গা মন্ত্রীত্ব না পেয়ে এমন কথা বলেছেন, এটা যেমন সত্য, তেমনি তাদের গোপন কোন ষড়যন্ত্র নেই, সেটাও উড়িয়ে দেয়া অনুচিত হবে।