নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে কূরুচিপূর্ণ বক্তব্যের বিষয়ে মঙ্গলবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল সংসদ অধিবেশন। বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার দেয়া বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন সরকার ও বিরোধী দলীয় সদস্যরা। তাদের দাবি, অবিলম্বে ওই বক্তব্য প্রত্যাহার এবং সংসদে দাঁড়িয়ে রাঙ্গাকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। মঙ্গলবার রাতে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা এই দাবি জানান।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনির্ধারিত আলোচনায় তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন প্রবীণ সংসদ সদস্যরাও। তাঁরা অবিলম্বে জাতীয় সংসদে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানানোর পাশাপাশি তাঁকে জাতীয় পার্টির মহাসচিবের পদ থেকে বহিস্কারের দাবি জানান।
তীব্র ক্ষোভ, উত্তেজনা ও অসন্তোষের মধ্যে দলের পক্ষ থেকে মশিউর রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যের জন্য দুঃখ ও ক্ষমা চেয়ে জাতীয় পার্টির দু’জন সিনিয়র সদস্য দাঁড়িয়ে বলেন, এটি জাতীয় পার্টির নয়, মশিউর রহমান রাঙ্গার একান্তই ব্যক্তিগত বক্তব্য। এর দায় জাতীয় পার্টি নেবে না। তবে তাঁর এই লজ্জাজনক বক্তব্যের কারণে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি, ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এক পর্যায়ে সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও মহাসচিবের কর্মকান্ডের কঠোর সমালোচনা করেন। এক সময় যুবদল করে আসা মশিউর রহমান রাঙা কীভাবে জাপা মহাসচিব, সাবেক প্রতিমন্ত্রী হলো তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
উত্তপ্ত বিতর্ক চলার সময় সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা। বিতর্ক চলাকালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের নিজ আসন থেকে উঠে গিয়ে অধিবেশনে থাকা সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কিছু সময় কথা বলেন। তবে অধিবেশনে এ নিয়ে কোন কথা বলেননি জি এম কাদের।
মাগরিবের নামাজের বিরতির পর পয়েন্ট অব অর্ডারে অনির্ধারিত এ বিতর্কের সূত্রপাত করেন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী। এ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে তুলোধুনো করেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, গণফোরামের সুলতান আহমেদ মনসুর আহমেদ, তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও মুজিবুল হক চুন্নু।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। মশিউর রহমান রাঙ্গা সেই চেষ্টা করেছেন। নুর হোসেন যখন হত্যা হয়, তখন দেশে ফেনসিডিল ইয়াবা ছিল না। ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু’র কথা বলা হয়। এই ভোট ডাকাতি-মিডিয়া ক্যু’র মূল হোতা ছিলেন প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। আজ সেটাকে ঢাকার জন্য রাঙ্গা এত বড় দুঃসাহস দেখাতে পারেন না। জাপা মহাসচিব রাঙ্গাকে অবশ্যই তাঁর কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।’
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘মশিউর রহমান রাঙ্গা এমন একটি বক্তব্য দিয়েছেন, তা বাংলার মানুষের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। নূর হোসেন হত্যার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয়, দেশের মানুষ রুখে দাঁড়ায়। অথচ রাঙ্গা সাহেব ভুলে গেছেন, এরশাদ সাহেব নুর হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, সংসদে ক্ষমা চেয়েছিলেন। অথচ রাঙ্গা শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। এই বক্তব্যের জন্য তাকে ধিক্কার জানাই। একজন সুস্থ্য মানুষ, তিনি যদি স্বাভাবিক থাকেন তার পক্ষে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী ও শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে এমন বক্তব্য দেওয়া সম্ভব না। আমি তাঁর বক্তব্যের ঘৃণা জানাই।’
সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘মশিউর রহমান রাঙ্গা যে কথা বলেছেন, এটা কোনো সুস্থ্য মানুষ বলতে পারেন না। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলার আগে তার চিন্তা করা দরকার ছিল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাকিস্তানের স্বার্থে কাজ করেছেন। রাঙ্গার এই বক্তব্য গণতন্ত্রের উপর আঘাত।’
গণফোরাম নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, শহীদ নুর হোসেনকে নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন মশিউর রহমান রাঙ্গা। যে নুর হোসেনকে সামনে রেখে আমরা আন্দোলন করেছি, তাকে তিনি কটাক্ষ করেছেন। এটা করে তিনি সংসদকে অপমান করেছেন। তাকে অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে।’
নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বলেন, ‘মশিউর রহমান রাঙ্গার বক্তব্যে শুধু নূর হোসেনের বিরুদ্ধে নয়, দেশের স্বাধীনতা, সংসদ ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি গণতন্ত্রের ধারাকে অপমান করেছেন। তার এই বক্তব্যের জন্য যদি জাতীয় পার্টি কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে জাতীয় পার্টি আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। ক্ষমা না চাইলে জাতীয় পার্টি থেকে রাঙ্গাকে বহিস্কার করতে হবে।’
তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘শহীদ নুর হোসেনকে নিয়ে অপমানজনক বক্তব্যের প্রতিকার চাই। মশিউর রহমান রাঙ্গা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটুক্তি করেছেন। তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। এরজন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এমন ধরণের দম্ভোক্তি থেকে বিরত থাকবেন, সেই প্রতিশ্রুতিও দিতে হবে।’
জাতীয় পার্টির মহাসচিবের বক্তব্যে নিয়ে সংসদে কড়া সমালোচনা করেছেন একই দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন, ‘বান্দরকে লাই দিলে গাছের মাথায় ওঠে। জাতীয় পার্টি নয়, রাঙ্গাকে এই লাই দিয়েছে আওয়ামী লীগ প্রতিমন্ত্রী করে। আমি যতদিন রাজনীতি করি ততদিন উনার বয়সও না। সে এই ধৃষ্ঠতা দেখায় কিভাবে? মশিউর রহমান রাঙ্গার বক্তব্য জাতীয় পার্টির নয়, একান্তই তার ব্যক্তিগত। এই বক্তব্যের জন্য জাতীয় পার্টি লজ্জিত, আমরা দুঃখিত ও অপমানিত অনুভব করছি। রাঙ্গাকে এই সংসদই লাই দিয়েছে। কি ধরণের লোককে যাদের অতীত নাই, বর্তমান কিছুই ছিল না, হঠাৎ তাকে মন্ত্রী বানানো হল। একটার পর একটা প্রমোশন দেওয়া হল। আমরা তো তাজ্জব হয়ে গেলাম। অতীতে সে করেছে যুবদল, কোথায় আন্দোলন করছে? কোথায় সংগ্রাম করছে? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে, প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কটুক্তি করার ধৃষ্টতা সে পেল কোথায় থেকে? নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মশিউর রহমান রাঙ্গার পেছনে না থাকলে সে রংপুরে নামতেও পারতো না। কার কত ভোট আছে আমাদের জানা আছে।’
এরআগে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘মশিউর রহমান রাঙ্গার বক্তব্যে জাতীয় পার্টি দলীয়ভাবে সমর্থন করে না। এটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। শহীদ নুর হোসেনের ব্যাপারে জাতীয় পার্টির কী দৃষ্টিভঙ্গি সেটা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নুর হোসেনের বাড়িতে গিয়েই দেখিয়েছিলেন। তার মা বাবার কাছে এরশাদ সাহেব দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করেছিলেন। এটাই জাতীয় পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি। এর বাইরে কেউ কিছু বললে সেটা তার বক্তব্য। তবে দোষ-ত্রুটি থাকলেও জাতীয় পার্টি গণতন্ত্রের জন্য আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছে, নির্বাচনে সহযোগিতা করেছে। এটা মনে রাখলে ভালো হয়।’