ক্রিকেটার হিসেবে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে চড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ম্যানেজার হিসেবে দীর্ঘদিন জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে দলের সুখ-দুঃখের অংশীদার ছিলাম। আর সূর্যতরুণের সংগঠক হিসেবে আমার পরিচিতিটা তো ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট অঙ্গনের সবার জানা। এসব পরিচয়ের ভিড়ে অনেকের অজানা যে, জাতীয় দলের নির্বাচকও ছিলাম আমি। কালের কণ্ঠর আমন্ত্রণে আসন্ন বিশ্বকাপের স্কোয়াড গড়তে গিয়ে আমি তাই যেন ফিরে গিয়েছিলাম ’৯৯-র বিশ্বকাপের পর থেকে ২০০২-এর শুরুর সময়টায়। আমার নির্বাচক জীবনে! টের পেলাম, কাজটি সেই আগের মতোই কঠিন রয়ে গেছে। বিশেষত কাউকে বাদ দেওয়ার পর্বটা। এই যে নাসির হোসেন, ইমরুল কায়েস, আবদুর রাজ্জাকদের আমি নিজের সেরা ১৫-তে রাখতে পারলাম না, সেটি সত্যি ভীষণ কষ্টের! সমান্তরালে সান্ত্বনা, ওদের চেয়ে যোগ্যরাই জায়গা পেয়েছে স্কোয়াডে। বিশ্বকাপের দল গড়ার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের উইকেটের কথা মাথায় রেখেছি। ভাবতে হয়েছে স্কোয়াডের যথাযথ ভারসাম্যের ব্যাপারও। গ্রুপ পর্বের ছয় প্রতিপক্ষের মধ্যে চারটি পরাক্রমশালী বলে বাংলাদেশের পক্ষে অভিন্ন একাদশে সবগুলো ম্যাচ খেলা সম্ভব হবে না। রদবদল হলে বিকল্প খেলোয়াড়রা যেন সত্যিকারের বিকল্প হতে পারে, সে চেষ্টা করেছি আমি। ওপেনার হিসেবে তামিম ইকবাল ও এনামুল হককে নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দারুণ ফর্মে থাকার প্রমাণ দিয়েছে দুজনই। ওদের বিকল্প হিসেবে লিটন দাস, মোহাম্মদ মিথুনরা বিবেচনায় আসতে পারত। এসেছেও, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনভিজ্ঞতার কারণে আমার স্কোয়াডে পায়নি জায়গা। তিন নম্বরে মমিনুল হক থাকছে। দারুণ এক ব্যাটসম্যান। যদিও আমি ঠিক নিশ্চিত নই, অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সি উইকেটে ও কতটা ভালো করবে। টপ অর্ডারে প্রথম ম্যাচের একাদশে রাখব তামিম-এনামুল-মমিনুলকে। এই তিনের বিকল্প হিসেবে ১৫ জনের স্কোয়াডে থাকবে আরেকজন। ফর্মের ওঠানামার কারণে শামসুর রহমানকে নিচ্ছি না। সে জায়গায় ধীরস্থির ইমরুলকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম এক রকম। পরে শেষ পর্যন্ত ওকেও বাদ দিয়ে গেলাম সৌম্য সরকারের দিকে। ইনজুরির কারণে তামিম কিংবা ফর্মের কারণে এনামুল-মমিনুল জ্বলে উঠতে না পারলে সৌম্যকে দিয়ে কাজ চালানো যাবে। বোনাস হিসেবে ওর মিডিয়াম পেস বোলিং তো থাকছেই। চার-পাঁচ-ছয় নির্বাচন ওপেনার বাছাইয়ের মতোই সহজ। সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদ উল্লাহ। সাকিবকে আমি চারে খেলাতে চাই কারণে ওকে মনে করছি দলের সেরা ব্যাটসম্যান। সাত নম্বর পজিশনে জোর লড়াই ছিল তিনজনের। সাব্বির রহমান, নাসির হোসেন ও মুক্তার আলী। খাতা-কলম নিয়ে রাত জেগে অনেক কাটাকুটির পর অবশেষে কেটে দিতে হলো মাঝের জনের নাম! সাব্বিরকে এখন সবাই চেনে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান হিসেবে, যে একটু-আধটু লেগ স্পিন পারে। আমার কাছে ওর পরিচয় কিন্তু ভিন্ন। ও সত্যিকার অলরাউন্ডার। সাকিবের মতো শুধু ব্যাটসম্যান কিংবা শুধু বোলার হিসেবে দলে ঢোকার দাবি রাখে। আমার ক্লাব সূর্যতরুণে একবার খেলল, লিগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট ছিল সাব্বিরের। পরে কী যে হলো ওর, রান আপ কমিয়ে দেওয়ার পর লেগ স্পিনের ধারটাও গেল কমে। তবু আমি মনে করি, টিম ম্যানেজমেন্ট কাজে লাগাতে পারলে এই ছেলেটি জাতীয় দলের সম্পদ হতে পারে। একাদশে খেলবে সাব্বির আর বিকল্প হিসেবে অপেক্ষা করবে মুক্তার। সত্যিকার অলরাউন্ডার হওয়ার সামর্থ্য আছে ওরও। ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ কার্যকর এক ক্রিকেটার। আমি মনে করি, উপযুক্ত মঞ্চ আর যথাযথ সমর্থন পেলে আন্তর্জাতিক আঙিনাতেও আলো ছড়াতে পারবে। নাসির এ ক্ষেত্রে মুক্তারের চেয়ে পিছিয়ে গেল দুটো কারণে। জাতীয় দলে এ বছরটা মোটেই ভালো কাটেনি। আর ওর অফ স্পিনের চেয়ে মুক্তারের পেস বোলিং অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে কাজ দেবে বেশি। একাদশের সাতজন এবং স্কোয়াডের ৯ জন দিয়ে দিলাম। এখানে রইল বাকি চার, ওখানে ছয়। একাদশের বাকি চারের মধ্যে আমি খেলাতে চাই তিন পেসার। মাশরাফি বিন মর্তুজার কথা কী আর বলব! জাতীয় দলের ম্যানেজার হিসেবে দেখেছি, ড্রেসিংরুমের গুমোট ভাব কিভাবে দু-একটা কথাতে উড়িয়ে দিতে পারে। হারতে থাকা ম্যাচেও কিভাবে সতীর্থদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় জয়ের আত্মবিশ্বাস! আর নিজে তো দুর্দান্ত এক বোলার। এই মাশরাফির সঙ্গে একাদশে আমার পছন্দ আল-আমিন হোসেন ও তাসকিন আহমেদ। তাদের কোনো একজনের ইনজুরি কিংবা ফর্মহীনতায় একাদশে ঢুকে যাবে রুবেল হোসেন। শফিউল ইসলাম, আবুল হাসানরা ছিল আমার প্রাথমিক সম্ভাবনাময়দের তালিকায়। শেষ পর্যন্ত ওদের বাদ দেওয়ার বিকল্প রইল না। রইল বাকি স্পিন। সাকিবের মতো অলরাউন্ডার থাকায় এখানে বাড়তি সুবিধা আছে। আর দুজন মাত্র স্পেশালিস্ট স্পিনার নিলেই চলে। নিচ্ছি লেগ স্পিনার জুবায়ের হোসেন ও বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলামকে। প্রথমজন চমক হিসেবে প্রথম ম্যাচের একাদশে থাকবে। তবে আমি সত্যি চমকে গিয়েছিলাম দ্বিতীয়জনের বোলিং দেখে। ওর লাইন অবিশ্বাস্য, বলের অর্ধেক থাকে অফ স্টাম্পের ভেতরে, অর্ধেক বাইরে। যেকোনো অধিনায়কের জন্য তাইজুল স্বপের বোলার। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের ব্যাটসম্যানদের ভড়কে দেওয়ার জন্য লেগ স্পিনারকে খেলাব। তবে আমি নিশ্চিত, আরো বহু বহু বছর জাতীয় দলকে সেবা দিয়ে যাবে তাইজুল। এরই মধ্যে অনেক দিন সেবা দেওয়া আবদুর রাজ্জাকের কথা ভেবেছি গভীরভাবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সেরা ১৫-তে ওর জন্য জায়গা পাইনি। আরাফাত সানির জন্যও না। নিষিদ্ধ না হলেও সোহাগ গাজীকে নিতে পারতাম না। তাইজুল ও জুবায়েরের সামর্থ্যে আমার এতটাই আস্থা।
তানজীব আহসান সাদের বিশ্বকাপ স্কোয়াড
তামিম ইকবাল, এনামুল হক, মমিনুল হক, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদ উল্লাহ, সাব্বির রহমান, মাশরাফি বিন মর্তুজা, আল-আমিন হোসেন, তাসকিন আহমেদ, জুবায়ের আহমেদ, সৌম্য সরকার, মুক্তার আলী, রুবেল হোসেন ও তাইজুল ইসলাম।
প্রথম ম্যাচের একাদশ : তামিম, এনামুল, মমিনুল, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদ, সাব্বির, মাশরাফি, আল-আমিন, তাসকিন ও জুবায়ের