ঢাকা: বহুল আলোচিত পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে একাধিক সংস্থা। ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়, মামলায় জড়িয়ে হয়রানি ও অন্যায়ভাবে সুবিধা আদায়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চাঁদার জন্য একাধিক শিল্পপতিকে তুলে নিয়ে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর অভিযোগে গত রোববার নারায়নগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার পদ থেকে হারুন অর রশীদকে পুলিশ অধিদপ্তরে বদলি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বদলি করে তাকে পুলিশ অধিদপ্তরে পুলিশ সুপার (টিআর) পদে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত তিনি বদলিকৃত পদে যোগদান করেননি।
সাবেক আইজিপি ও বর্তমান সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বলেন, পুলিশের মূল কাজ হচ্ছে আইন-শৃংখলা রক্ষায় মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেয়া। এসপি হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উঠেছে তা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। এ বিষয়ে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা অথবা শক্তভাবে শৃংখলামূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে অন্যরাও একই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ থাকে। এ জন্য বিষয়টি দ্রুত সুরাহা হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হারুনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠলেও প্রভাবের কারণে কেউ কিছু বলতে পারেননি। বরং অভিযোগ থাকার পরও সব সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগ করেন পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ছেলে ও আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ ওরফে রাসেল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ সুপার হারুনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, চাঁদাবাজি ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সুবিধা আদায়সহ দীর্ঘ অভিযোগ রয়েছে। এ সব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা এ সব অভিযোগ তদন্ত করছেন বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ ওরফে রাসেল সাংবাদিকদের জানান, চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে না পেয়ে তার স্ত্রী-সন্তানকে তুলে নিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। পরে তারা মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।
ওই ঘটনার বিবরণ দিয়ে শওকত আজিজ আরো বলেন, চাঁদা নিয়ে হারুন অর রশীদের সঙ্গে তার পুরোনো বিরোধ ছিল। স¤প্রতি তিনি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে নতুন একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছেন। সেখানেও হারুন বাগড়া দিচ্ছিলেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার তিনি তার স্ত্রী-পুত্রকে একটি পার্টিতে নামিয়ে ঢাকা ক্লাবে যান। ক্লাব থেকে বেরিয়ে দেখেন তার গাড়িটি নেই। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন গাড়ি আছে নারায়ণগঞ্জে। পরদিন রাতে তার অনুপস্থিতিতে হারুন একদল পুলিশ নিয়ে তার গুলশানের বাসায় ঢুকে ভাংচুর করেন। এরপর তার স্ত্রী-সন্তানকে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যান। এ বিষয়ে নিকটস্থ গুলশান থানাকে কিছু জানায়নি নারায়ণগঞ্জের পুলিশ। পরদিন তার খোয়া যাওয়া গাড়িতে ইয়াবা, মদ ও গুলি উদ্ধারের ঘটনা সাজিয়ে তার ও তার গাড়িচালকের নামে মামলা করেন। গুলশানের বাসা থেকে স্ত্রী-সন্তানকে তুলে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও শওকত তার ফেসবুকে েেশয়ার করেন।
গত শনিবার নিজের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এসপি হারুন অর রশীদ দাবি করেন, শওকত আজিজের গাড়ি থেকে ২৮টি গুলি, ১ হাজার ২০০ ইয়াবা বড়ি, ২৪ বোতল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ, ৪৮ ক্যান বিয়ার উদ্ধার করা হয়েছে। ওই সময় গাড়িতে শওকতের স্ত্রী ফারাহ রাসেল ও সন্তান আনাব আজিজ ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের আটক করা হয়েছিল। পরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে এম এ হাসেম সহযোগিতা করবেন বলে মুচলেকা দেওয়ায় তার স্ত্রী-পুত্রকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে তা সঠিক নয়। একটি মামলার প্রেক্ষিতে আম্বার গ্রæপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ ওরফে রাসেলের বাসায় অভিযান চালানো হয়। ওই বাসা থেকে রাসেলের ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়। এ সময় তার স্ত্রী (রাসেল) স্বেচ্ছায় পুলিশের সাথে চলে আসেন। পরে লিখিত নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাকে বদলি করা হয়েছে, দু’এক দিনের মধ্যে পুলিশ অধিদপ্তরে যোগদান করবো।
শওকত আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, হারুনের চাঁদাবাজি নিয়ে ২০১৬ সালের ৫ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে তিনি একটি লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচন কমিশনের আদেশে গাজীপুর থেকে প্রত্যাহারের পর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ তার কাছ থেকে ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। তার পক্ষে উপপরিদর্শক আজহারুল ইসলাম আম্বার ডেনিমের স্টোর ম্যানেজার ইয়াহিয়া বাবুকে ফোন করে টাকা দাবি করেন। এর আগেও গুলশান ক্লাবের লামডা হলে ও গুলশানের কাবাব ফ্যাক্টরি রেস্তোরায় হারুন তাকে ডেকে নিয়ে ৫ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঠিকানায় পাঠাতে বলেন। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আম্বার ডেনিমের ৪৫ জন শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গাজীপুর থানায় ধরে নিয়ে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো হয়। শুধু শওকত আজিজই নন, গত ২৭ অক্টোবর রাতে হারুনের লোকেরা আরও একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও তার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে গুলশান থেকে তুলে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে আটকে রাখেন। পরে জার্মানপ্রবাসী একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা এবং পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুরোধে শিল্পপতিকে ছেড়ে দিলেও প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এখনো ওই কর্মকর্তা কারাগারে আছেন।
যেভাবে আলোচনায় আসেন এসপি হারুন
২০১১ সালের ৬ জুলাই ঢাকায় হরতাল চলছিল। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় তখনকার বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে ফারুককে পিটিয়ে আলোচনায় আসেন এসপি হারুন অর রশীদ। এরপর তার বিতর্কিত কর্মকান্ড সামনে আসতে থাকে, যা এখনও বিদ্যমান। ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় তিনি গাজীপুরের এসপি ছিলেন। তখন তার বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে আপত্তি জানায় বিএনপি। ওই নির্বাচনের সময় কিছুদিনের জন্য তাকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে আবার তাকে সেখানেই দায়িত্ব দেয়া হয়। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের সময়ও বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ের অভিযোগ উঠে এসপি হারুনের বিরুদ্ধে। সে-সময় নির্বাচন কমিশন থেকে তখন তাকে পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করার জন্যও বলা হয়। উল্লেখ্য, হারুন ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের এসপি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার আগে ২০১৪ সালের ২৪ আগস্ট পুলিশ সুপার হিসেবে গাজীপুরে যোগদান করেন তিনি।