ফরিদা ইয়াসমিন: দেশে দেশেই সাংবাদিকরা আজ নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে আছেন। এই ঝুঁকি ক্রমশই বাড়ছে। সময়ের সঙ্গে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এসেছে নানা পরিবর্তন, সেই সঙ্গে নিরাপত্তা ঝুঁকি নানা মাত্রা পেয়েছে। গণমাধ্যম নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। পথপরিক্রমায় গণমাধ্যম এখন ডিজিটাল যুগে। তথ্যের অবাধ প্রবাহে তথ্য বিপ্লব ঘটেছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে তথ্য বিভ্রান্তি। মিথ্যা ও গুজবকেও কখনো কখনো তথ্য বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তথ্য বিভ্রান্তিতেও সাংবাদিকরা পড়ছেন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। সাংবাদিকতার জন্য এটি এক নতুন চ্যালেঞ্জ।
দেশে দেশেই পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে সাংবাদিকদের হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের হিসাব মতে, ২০০৭ থেকে এ পর্যন্ত ১০৫৩ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এ সময় বাংলাদেশে সাগর-রুনিসহ ১৪ সাংবাদিক নিহত হন। এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এ বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি তার এক ভাষণে বলেন, ২০১৮ সালে ৯৯ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী নিহত হয়েছেন, তিনশ’র বেশি আটক এবং ৬০ জন জিম্মি হয়েছেন। সাংবাদিকরা কখনো খুন হচ্ছেন, কখনো শারীরিক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া সাংবাদিকদের নিজেদের এবং তাদের পরিবারকে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়ে মানসিক চাপে রাখা, মামলা করে হয়রানি করা, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, গ্রেফতার ও আটক, অনলাইন হয়রানি ইত্যাদি তো আছেই।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের অনলাইন হয়রানি নতুন করে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যে কোনো সাংবাদিকের চরিত্র হনন করা হচ্ছে। কখনো মিথ্যা তথ্য দেওয়া হচ্ছে, কখনো ভুয়া ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে ওই সাংবাদিক পারিবারিক, সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সাংবাদিককে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকের নামে কুৎসা রটনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করা হয়েছে। নারী সাংবাদিকরাও অনলাইনে যৌন হয়রানিসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ডিজিটাল মাধ্যম সাংবাদিকতার নানা দ্বার উন্মুক্ত করেছে। সাংবাদিকতাকে বদলে দিয়েছে। তেমনি সাংবাদিকতায় নানা চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়েছে। তথ্য জানার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে মানুষ। কারণ এখানে যে কোনো তথ্য দ্রুত পাওয়া যায়। যে যখন যা পাচ্ছে তা জানিয়ে দিচ্ছে। সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের কোনো বালাই নেই। একজন সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমকে সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে পরিবেশন করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত সাংবাদিকদের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
একটি গণতান্ত্রিক দেশের পূর্বশর্ত হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর কিছু ধারা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। এর আগে সরকার ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬’ অনুমোদন দেয়। এর কিছু ধারা নিয়ে সাংবাদিকরা আপত্তি করলে সরকার এই আইনটি বাতিল করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ প্রবর্তন করে। তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ধারায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে তাও বহাল আছে। সাংবাদিকরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছেন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এই আইনটি প্রয়োগ না করার জন্য। তবে সরকার বলছে এই আইনটি সাংবাদিকদের জন্য নয়। ডিজিটাল হয়রানি রোধে এ আইনটি করা হয়েছে। ডিজিটাল হয়রানির জন্য এ ধরনের একটি আইনের প্রয়োজন আছে, এটি স্বীকার করি। কিন্তু এই আইনের আওতায় সাংবাদিকরা যেন হয়রানির শিকার না হন আমাদের দাবি সেটি। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইনটি পাস করে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। আইনটি পাসের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে জনগণের জানার অধিকারকে নিশ্চিত করে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ আইনটি পাস করা হয় বলে উল্লেখ করেন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে এ আইনটি সাংবাদিকদের কাজে লাগছে। কোনো প্রতিষ্ঠান তথ্য দিতে অনিচ্ছুক হলেও এই আইনের আওতায় তথ্য দিতে বাধ্য হচ্ছে। বর্তমানে ৪টি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত চ্যানেলসহ ৩৪টি টেলিভিশন চ্যানেল, ২২টি এফএম রেডিও, ১৭টি কমিউনিটি রেডিও এবং প্রায় ২৮০০ পত্রিকা আছে। বর্তমান সরকারই গণমাধ্যমের এই নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কিন্তু সাংবাদিকদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। অর্থনৈতিকভাবে সুরক্ষিত না থাকলে একজন সাংবাদিক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। চাকরির অনিশ্চয়তা, বেতনের অনিশ্চয়তা সাংবাদিককে হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে। সাংবাদিকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জরুরি।
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের নিরাপত্তা না থাকা এবং সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া গণমাধ্যমের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের প্রয়োজন রক্ষাকবচ। জাতিসংঘ মহাসচিব বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের সুরক্ষায় অনুকূল পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে একটি আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। এই ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা কর (ডিফেন্ড মিডিয়া ফ্রিডম)’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ১০-১১ জুলাই লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
যুক্তরাজ্য ও কানাডা সরকার যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘গ্লোবাল কনফারেন্স ফর মিডিয়া ফ্রিডম’ আয়োজন করে। একজন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আমার সেই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সম্মেলনে মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী আমাল ক্লোনি জানান, বিশ্বের মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ভোগ করে। পেশাগত কারণে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতন বাড়ছে। সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্ব নেতারা নিন্দা প্রকাশ ছাড়া কিছুই করেননি। আফ্রিকার এক সাংবাদিক সম্মেলনে নিজের নিরাপত্তা হুমকির কারণে মুখ ঢেকে কথা বলেছেন। সম্মেলনে বলা হয়, দেশে দেশেই কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বড় বাধা। প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যেভাবে বিকাশ ঘটছে, আগামী দিনগুলোতে মত প্রকাশ ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য গণমাধ্যমের প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। সরকারকেও এর সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে।
সাংবাদিকতার নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবার আগে তার নিজকে সচেতন থাকতে হবে। প্রযুক্তির এ সময়ে নিজকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা বলয় তৈরি করাও জানতে হবে। শারীরিক ও ডিজিটাল দুভাবেই তার নিরাপত্তার কৌশলগুলো আয়ত্তে থাকতে হবে। পেশার মানোন্নয়ন ও পেশার স্বার্থে সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, একজন সাংবাদিককে কোনো রকম আক্রমণ মানে পেশাকে আক্রমণ, পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা, পেশাকে ছোট করা। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। নিজের পেশার মানুষকে ছোট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু ছড়িয়ে দেওয়ার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কাদা ছোড়াছুড়ি না করে পেশার মর্যাদা রাখতে হবে। পেশাগত কারণে আর কোনো সাংবাদিককে যেন হত্যা, হামলা বা হুমকির সম্মুখীন হতে না হয় সে জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। গণমাধ্যমকর্মী, সুশীল সমাজ এবং সরকারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায়। কারণ মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য প্রয়োজন সাংবাদিকের নিরাপত্তা। আর মুক্ত গণমাধ্যম একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব।