ঢাকা: কে জানে, নিয়তি হয়তো রহস্য ভালোবাসে। এমনিতে দুই প্রতিবেশি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু ক্রিকেট মাঠে সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশ-ভারত লড়াই বারুদের উত্তাপে ঠাসা। পুরনো দিনের ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের গন্ধ পাওয়া যায় এখানে। যদিও বাংলাদেশের জন্য বরাবরই হৃদয় ভেঙে দেয়ার গল্প। কতবার যে জেতা ম্যাচ হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। ক্রিকেট কি আর কখনও এতো ট্র্যাজেডি দেখেছে। সেই নিয়তি এবার কিছু দেনা শোধ করা শুরু করেছে।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুতে ১ রানের হার। সেই হারে জড়িয়ে আছে মুশফিক-মাহমুদুল্লাহর নাম। তীরে এসে তরী ডুবানো। ২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালের শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে মুঠো থেকে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন দিনেশ কার্তিক। আগের ৮ বারের দেখায় যে ভারতকে একবারও হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। সেই ভারতকেই সাকিব, তামিমকে ছাড়াই নবম সাক্ষাতে ৭ উইকেটে হারিয়ে দিল টাইগাররা। ঐতিহাসিক জয়ে ৬০ রানের দারুন এক ইনিংস খেলে বেঙ্গালুরুর আগাম উদযাপনের ক্ষতটা ঘোচালেন মুশফিকুর রহীম। আগামী বৃহস্পতিবার রাজকোটে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হবে দু’দল।
ভারতের মাটিতে কোনো সংস্করণেই জয় নেই বাংলাদেশের। এমন এক পরিস্থিতিতে ভারতে সিরিজ খেলতে গিয়েছে ভগ্ন হৃদয় নিয়ে। তিন সপ্তাহে ক্রিকেটে কী না হয়ে গেলো! ১৩ দফা দাবিতে ক্রিকেটারদের ধর্মঘট। ধর্মঘটের বিরুদ্ধে বিসিবি সভাপতির কঠোর অবস্থান। নানা নাটকের পর ক্রিকেটারদের সেই ধর্মঘট প্রত্যাহার। পারিবারিক কারণে হঠাৎ করে সিরিজ থেকে তামিম ইকবালের নাম প্রত্যাহার। আর আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় ছিটকে গেলেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। ইনজুরির কারনে ছিটকে গেছেন টি-টোয়েন্টি দলের অপরিহার্য অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনও। তবু উজ্জীবিত এক বাংলাদেশের দেখা মিলেছে গতকাল দিল্লির অরুন জেটলি স্টেডিয়ামে। দূষণের শঙ্কা শেষে ম্যাচের শুরু হতেই ভারতকে চেপে ধরে বোলাররা। প্রথমে যে উইকেটে রান উৎসব হবে বলে ভাবা হয়েছিল, সে উইকেটেই ভারতকে ১৪৮ রানে আটকে দেয় বাংলাদেশ। বল হাতে দুটি করে উইকেট নিয়ে ভারতকে দেড়’শর আগে আটকে রাখেন আমিনুল বিল্পব, আফিফরা। তবে ব্যাটিংয়ের শুরুতে লিটনের বিদায়ে ধাক্কা লেগেছিল। এমন অবস্থাতে নেমে দলকে রান তাড়া করার কঠিন কাজ থেকে বিচ্যুত হতে দেননি সৌম্য। অভিষিক্ত নাঈম শেখের সঙ্গে ৪৬ ও অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহীমের সঙ্গে ৬০ রানের দুটি জুটি গড়েছেন। ৩৫ বলে ৩৯ রান করেছেন। মুশফিকের সঙ্গে জুটি গড়ার সময় মনে হচ্ছিল ম্যাচ থেকে ছিটকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু সৌম্য জানালেন তারা জানতেন শেষ দিকে ম্যাচ বের করা যাবে, ‘আমরা সবাই শান্ত ছিলাম। জানতাম ধৈর্য ধরলে এটা সম্ভব।’ ৬০ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা মুশফিকুর রহীমও জানালেন ধৈর্য ধরলে জয় আসবেই। আর সেটাই হয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে এতো দর্শকের সামনে খেলার অনুভূতি অসাধারণ। ম্যাচ শেষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাপের মধ্যে থাকা দলকে এমন জয়ে অভিন্দন জানিয়েছেন আইসিসির নিষেধাজ্ঞার কারণে দলে না থাকা নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব আল হাসান।
১৪৯ রানের টার্গেটে অভিষিক্ত মোহাম্মদ নাঈম ও সৌম্য সরকার প্রথম ৬ ওভারে ৪৫ রান এনে দেন। জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় গতিতেই তখনো এগুচ্ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু যুজবেন্দ্র চাহাল বোলিংয়ে এসেই বদলে দিলেন সব। ২৮ বলে ২৬ রান করে ফিরলেন নাঈম। ৫৪ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারাল বাংলাদেশ। চাহালের লেগ স্পিন থেকে রানই বের করতে পারছিলেন না মুশফিকুর রহীম ও সৌম্য সরকার। চাহালের প্রথম দুই ওভারে মাত্র ২ রান তুলতে পেরেছে বাংলাদেশ। ১০ ওভার শেষে ২ উইকেটে ৬২ রান। বাকি সময়ে দরকার ৮৭ রান। সেটা ৫ ওভারে নেমে এল ৫০-এ। হাতে তখনো ৮ উইকেট। ৩৪ রানে সৌম্য আছেন এক প্রান্তে, অন্যপ্রান্তে ২৮ রানে মুশফিক। টি-টোয়েন্টিতে এমন পরিস্থিতিতে ব্যাটিং দলই এগিয়ে থাকে। ১৬তম ওভারে মাত্র ৬ রান আসায় চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। খলিল আহমেদের প্রথম বলেই হুক করে ছক্কা মারলেন। কিন্তু পরের দুই বলেই আবার ডট। পরের দুই বলে তিন রান এল। ষষ্ঠ বলেই আবার হতাশায় ডুবল বাংলাদেশ। উইকেটের পেছনে বল পাঠাতে গিয়ে গতিতে বিভ্রান্ত হয়ে বোল্ড সৌম্য। ৩৫ বলে ৩৯ রানের ইনিংসে দুই ছক্কার সঙ্গে এক চার ছিল তাঁর। ১৮তম ওভারের তৃতীয় বলে আবার জীবন পেলেন মুশফিক। সীমানায় তাঁর সহজ ক্যাচ হাতছাড়া করে চার বানিয়ে দেন ক্রুনাল পান্ডিয়া। ৩৮ রানে জীবন পেলেন মুশফিক। চাহালের সে ওভারে ১৩ রান পেয়েছে বাংলাদেশ। শেষ ১২ বলে ২২ রান দরকার ছিল বাংলাদেশের। প্রথম দুই দলে মাত্র ২ এল। পরের চার বলে টানা চার ৪ মুশফিকের। শেষ ওভারে দরকার ৪ রান। তবে উইকেটে থাকা মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ একবার শেষ ৩ বলে ২ রান তোলার কাজ করতে পারেননি টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। অতীত স্মরন করেই অস্বস্তি বাড়াচ্ছিল। প্রথম বলেই ডট দিলেন মাহমুদুল্লাহ। ৫ বলে দরকার ৪ রান। পরের বলে ২ রান নিয়ে চাপ কমালেন অধিনায়ক। পরের বলেই ওয়াইড। ম্যাচ টাই। ৪ বলে ১ রান দরকার বাংলাদেশের। ছয় মেরেই জয় নিশ্চিত করলেন টাইগার অধিনায়ক। অপর প্রান্তে ৬০ রানে অপরাজিত ছিলেন ম্যাচ সেরা মুশফিক।
এর আগে অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহর সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করেছেন পেস বোলাররা। টসে জিতে ফিল্ডিং বেছে নেওয়া বাংলাদেশ আঘাত হানে প্রথম ওভারেই। প্রথম ৫ বলে দুই চার মারা রোহিত শর্মাকে (৯) ওভারের শেষ বলে এলবি করেন শফিউল ইসলাম। প্রথম স্পেলে উইকেট না পেলেও তিন বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা আল-আমিন হোসেন দারুণ করেছেন পাওয়ার প্লেতে। প্রথম ২ ওভারে মাত্র ৬ রান দিয়েছেন আল-আমিন। শ্রেয়াস আয়ার নামার পর ভারতের রানের গতি বেড়েছে। ১০ ওভার শেষে ভারতের স্কোর ছিল ২ উইকেটে ৬৯ রান। আমিনুলের বলে দুটি ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন আয়ার। কিন্তু শেষ হাসি বাংলাদেশের লেগ স্পিনারের। তাঁকে হাঁকাতে গিয়ে অভিষিক্ত মোহাম্মদ নাঈমকে প্রথম ক্যাচের স্বাদ দিয়েছেন আয়ার। ১৩ বলে ২২ রান করে ফিরেছেন আয়ার। ইনিংসের একপ্রান্ত ধরে রেখেছিলেন শিখর ধাওয়ান। কিন্তু যখনই ইনিংসের গতি বাড়ানো দরকার ছিল তখনই রান আউট হয়ে গেছেন ধাওয়ান। দলকে ৯৫ রানে রেখে ফিরেছেন এই ওপেনার। তাঁর ৪২ বলে ৪১ রানের ইনিংসে ছিল ৩ চার ও এক ছক্কা। এর পর ইনিংস ধরে রাখার কাজ করেছেন ঋষভ পন্ত (২৬ বলে ২৭ রান)। অভিষিক্ত দুবেকে দুর্দান্ত এক ক্যাচে বিদায় দিয়েছেন আফিফ। শেষ দুই ওভারেই ঝড় তুলেছে ভারত। শেষ দিকে ওয়াশিংটন সুন্দরের ৫ বলে ১৪ রানে ও ক্রুনাল পান্ডিয়ার ৮ বলে ১৫ রানে ৩০ রান এসেছে ১৯ ও ২০তম ওভারে। এতেই ১৪৮ রানের পুঁজি পায় ভারত। বিল্পব, সফিউল দুটি করে উইকেট নিয়েছেন।