ঢাকা: জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে বিস্মিত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। দলে অনুপ্রবেশের জোয়ার দেখে তাদের এ বিস্ময়। বেশির ভাগ জায়গায় এমনটা হয়েছে স্থানীয় এমপির মাধ্যমে। তাদের হাত ধরেই বেশি অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা এরই মধ্যে বিষয়টি দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়েছেন তিনি। দলটির শীর্ষ কয়েক নেতা বলেন, সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনের পরপরই সুবিধাবাদীরা এমপির চারপাশে সক্রিয় হয়। এতে আকৃষ্ট হয়ে আবার কিছু ক্ষেত্রে সুবিধার বিনিময়ে বিভিন্ন কমিটিতে অনুপ্রবেশকারীদের স্থান দেয়া হয়েছে।
মূলত বেশিরভাগ জায়গায় এমপিদের হাত ধরে অনুপ্রবেশকারীরা দলে যোগ দিয়েছেন।
তাদের কারণে তৃণমুল আওয়ামী লীগে আজ এত দ্বন্দ, বিভেদ। এদিকে শীর্ষ নেতাদের সাংগঠনিক সফরের পরপরই টেনশনে পড়ছেন এমপিরা। অনুপ্রবেশকারীরা তাদের জন্য এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এরই মধ্যে কয়েক এমপিকে ডেকে অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। আরও বেশ কয়েক এমপিকে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছেন। দলীয় নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টেও এমপিদের হাত ধরে অনুপ্রবেশকারীরা দলে যোগ দিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, মূলত ২০০৮ সালের পর শুরু হয় আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। একইভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগদানের হিড়িক পরে। এদের বেশিরভাগই বিএনপি-জামায়াত-শিবির ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির লোকজন। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও এমপি-মন্ত্রীর হাত ধরে এই অনুপ্রবেশ ঘটে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংগঠনিক সফরে যাওয়া নেতাদের কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি কোন অনুপ্রবেশকারিকে দল থেকে বের করে দেয়ার সময় যদি কেউ পক্ষে সুপারিশ করে কিংবা গুনগান গায় তাহলে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে বার্তা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন,অনুপ্রবেশকারীদের কারনে অনেক এলাকায় দলের ত্যাগী নেতারা রয়েছেন কোনঠাসা অবস্থায়।
এমনকি অনেক আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্যদের বানানো হয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী পরিবার। অনুপ্রবেশকারীদের দাপটে তৃনমুল নেতাদের অবস্থা শোচনীয়। অনেক এলাকায় সক্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। দলীয় কর্মকান্ডে তাদের সম্পৃক্ত করা হয় না। দলের স্থানীয় নেতাদের আশপাশেও তারা ভীড়তে পারেন না। নানা কারণে দলে অনুপ্রবেশকারীরা শক্ত অবস্থান গড়েছেন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তারা জানান, বিভিন্ন উপজেলায় সাংগঠনিক সফরে গিয়ে আমাদের বিস্মিত হতে হয়েছে। অনুপ্রবেশ ইস্যুতে তৃনমুল নেতাকর্মীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিদের দায়ী করেছেন। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক আবদুর রহমান মানবজমিনকে বলেন,এরইমধ্যে আমি যশোর, নড়াইল ও মাগুরা জেলার ৮টি উপজেলায় সাংগঠনিক সফরে গিয়েছি। সেখানে তৃনমুল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছি। কমিটি গঠন নিয়ে দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কমিটি গঠনে অনুপ্রবেশকারীদের যেনো কোনভাবেই স্থান না দেয়া হয় সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। তিনি বলেন,এরইমধ্যে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে।
তারা আগে বিভিন্ন দল করতো। কারও বিরুদ্ধে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মামলা। আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে মারামারি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে দলকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, দলের সভাপতি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন-আওয়ামী লীগে কোন অনুপ্রবেশকারীর স্থান হবে না। তাদের বহিস্কারের সময় যদি কেউ সুপারিশ করে তাদের বিষয়েও কঠোর ব্যাবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, সেটা যদি মন্ত্রী, এমপি কিংবা দলের বড় কোন নেতা হোন তার বিষয়েও ছাড় দেয়া হবে না। অনুপ্রবেশ নিয়ে এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি। তবে যার হাত ধরেই অনুপ্রবেশ হোক না কেন কেউ ছাড় পাবেন না। কোন কমিটিতেও স্থান দেয়া হবে না। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে দলকে সুসংগঠিত ও হাইব্রিডমুক্ত করতে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা প্রস্তুত করেছে দলটি। বিগত সময়ে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা করতে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বার বার তাগাদা দিয়েও কাজ হয়নি। পরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও নিজস্ব টিমের তত্ত্বাবধানে দলে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা প্রস্তুত করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। অনুসন্ধানে প্রায় ৫ হাজার ব্যক্তিকে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হাজার পৃষ্ঠার দুটি বইয়ে এসব বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা উঠে এসেছে। এর আগে ৩১ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের কাছে বই দুইটি হস্তান্তর করেন।
এ সময় তিনি দলে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের তালিকা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তাদের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালানোর নির্দেশ দেন। সমপ্রতি গণভবনে ছয়জন নেতাকে নিয়ে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের নিদের্শ দেন এইসব অনুপ্রবেশকারীদের এখনই দলের পদ-পদবী থেকে বাদ দিতে। একইসঙ্গে আগামীতে যেন অনুপ্রবেশ না ঘটে সে ব্যাপারে সর্তক থাকতে বলেন তিনি। ছয় মাস ধরে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব টিম অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরি করে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের হাতে তালিকা দিতে নিদের্শ দেন।