ঢাকা: প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা তার নেই। তবু তিনি ‘কাজী সাহেব’। বর-কনের বয়স কম কিন্তু বিয়ে দিতে বা করাতে হবে এমন বিয়ে নিবন্ধন করা তার জন্য মামুলি ব্যাপার। এলাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি অবাধেই বিচরণ করেন। প্রতিনিয়তই বাল্য বিয়ে পড়াচ্ছেন। আর এ সব অবৈধ বিয়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা নিয়ে বিপাকে পড়ে কয়েকটি পরিবার। কিন্তু নাজমুলের দ্বারস্থ হয়ে কোনো ধরনের সুরাহা পাচ্ছিল না। অনেকেই তাকে না পেয়ে বিয়ের নকল নিতে না পেরে পড়েছেন বিপাকে। অবশেষে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া কথিত কাজী নাজমুলকে বৃহস্পতিবার সকালে কৌশলে আটকিয়ে পিঠমোড়া করে বেঁধে পুলিশে দেন ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার রাজৈ ইউনিয়নের চালাবো গ্রামের ভুক্তভোগীরা। মামলার পর আজ শুক্রবার তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
কথিত কাজী নাজমুল আলম (৪০) ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার শেরপুর ইউনিয়নের উত্তর শেরপুর গ্রামের আব্দুল হাই মাস্টারের ছেলে। স্থানীয়রা জানান, মসজিদ ভিত্তিক কিছু লেখা পড়া ছাড়া তার প্রাতিষ্ঠিনিক কোনো শিক্ষা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নান্দাইলের নিকাহ নিবন্ধক নুরুল ইসলামের বই নিয়ে তিনি বিয়ে রেজিস্ট্রির কাজ করছেন গত প্রায় এক যুগ ধরে। নান্দাইলসহ আশপাশ উপজেলায় যত বাল্যবিয়ে হচ্ছে তার বেশিরভাগ হচ্ছে তার হাত দিয়ে। বিশেষ উপায়ে জন্ম নিবন্ধন তৈরি করে এই বিয়েগুলি পড়ান অত্যন্ত গোপনে। তাকে ধরতে নান্দাইল উপজেলার ইউএনও সম্প্রতি সকল কাজীকে ডেকে নাজমুলকে দেখা মাত্রই আটক করার নির্দেশ দেন। আর এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার বাল্য বিয়ে পড়াতে গিয়ে ভালুকায় ধরা পড়েন তিনি।
ভালুকা উপজেলার চালাবো গ্রামের ইউপি সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে সজীব সরকার মুঠোফোনে বলেন, নান্দাইলের কাজী পরিচয়ে নাজমুল আলম প্রতিনিয়ত এলাকায় গিয়ে বিয়ে নিবন্ধন করান। তিনি মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে গত পাঁচ মাসে প্রায় অর্ধশতাধিক বাল্যবিবাহও নিবন্ধন করিয়েছেন।
সম্প্রতি একটি বিয়ের ঘটনা নিয়ে আদালতে মামলা হয়। কনের বাবা নাজমুলের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা দিয়ে বিয়ের কাবিননামার সত্যায়িত (সার্টিফায়েড) অনুলিপি সংগ্রহ করেন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। বিয়ের প্রমাণ হিসেবে সেটি আদালতে প্রদর্শন করা হয়। একটি সূত্র জানায়, কাবিননামায় স্বাক্ষর ছিল নান্দাইলের আরেক কাজী মো. নুরুল ইসলাম নামের এক জনের। আদালত থেকে নোটিশ পেয়ে নুরুল ইসলাম আদালতে হাজির হন। তিনি কাবিননামা দেখে আদালতকে বলেন, এ বিয়ে তিনি পড়াননি। স্বাক্ষরটিও নাকি তার নয়।
এদিকে আজ শুক্রবার বিকেলে তার সাথে কথা হলে তিনি আদালতে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, নাজমুলের কাছে আমার একটি বই ছাড়া অন্য আরেক জনের কাছে আরেকটি বই আছে। এ ঘটনা জানার পর এখন বই আনার চেষ্টা করছি। আপনি কোন এলাকার কাজী জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনটি ইউনিয়নেরই কাজ করছি। তাছাড়া অর্ডার পেলেই কোথাও যেতে বাধা নেই।
আদালতে নুরুল ইসলাম কাজীর এ ধরনের শুনানির খবর ভালুকা উপজেলার চালাবো গ্রামে জানাজানি হয়। ফলে ভুয়া কাজি নাজমুল আলমের দ্বারা নিবন্ধিত অনেকগুলো বিয়ের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এ নিয়ে চালাবো গ্রামে চাঞ্চল্য দেখা দিলে মোটা অঙ্কের টাকা প্রলোভন দেখিয়ে আরেকটি বিয়ে নিবন্ধন করানোর জন্য নাজমুলকে চালাবো গ্রামে ডেকে নেওয়া হয়। প্রলোভনে পড়ে গত বৃহস্পতিবার সকালে নাজমুল ওই গ্রামে ছুটে যান। সেখানে পৌছানোর পর এলাকার লোকজনের রোষানলে পড়েন। শুরু হয় উত্তম-মাধ্যম। একপর্যায়ে তাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে থানায় হস্তান্তর করা হয়।
চালাবো গ্রামের মোহাম্মদ সুন্নত আলীসহ চারজন জানান, একটি বাল্যবিবাহ নিবন্ধন করানোর জন্য ভুয়া কাজী নাজমুলকে ২২ থেকে ৩০ হাজার দিতে হয়েছে। ঘটনা জানার পর তাকে তারা থানা-পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
ভালুকা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ভুয়া কাজীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর তাকে শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
নান্দাইল পৌরসভার নিকাহ নিবন্ধক মো. গোলাম মওলা গোলাপ জানান, নাজমুল আলম বৈধ কাজী নন। তিনি কাজী হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করছেন। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।