ঢাকা: আবারো ভাঙনের মুখে পড়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি। দলের শীর্ষ নেতাদের আদর্শচ্যুতির অভিযোগ তুলে ইতিমধ্যে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বিমল বিশ্বাস পার্টি ছেড়ে দিয়েছেন। পার্টির আসন্ন কাউন্সিল বর্জনের ডাক দিয়েছেন পলিট ব্যুরোর দুই সদস্যসহ কেন্দ্রীয় ছয় নেতা। আগামী ২রা নভেম্বর শুরু হবে পার্টির দশম কংগ্রেস। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের এই কংগ্রেসে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী অনেক নেতাই অংশ নিচ্ছেন না। তারা পৃথম একটি দল গঠনেরও চিন্তা করছেন। ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কবাদী) এই নামে দলত্যাগী নেতারা অন্যন্য বাম সংগঠনগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করারও চিন্তা করছেন। পার্টি কংগ্রেস শেষ হওয়ার পরই তাদের এ কার্যক্রম দৃশ্যমান হবে বলে নেতারা জানিয়েছেন।
১৪ দলের সঙ্গী হয়ে নির্বাচন ও মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করায় শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আগে থেকেই নাখোশ ছিলেন অনেক নেতা। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করে পরে অবস্থান থেকে সরে আসায় দলেই ক্ষোভের মুখে পড়েন পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ‘আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলছি, নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারে নাই’ মেননের এমন বক্তব্যের পর অনেকে সাধুবাদ জানালেও আওয়ামী লীগের তরফে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে মেনন অবস্থান থেকে সরে এসে বিবৃতি দিতে বাধ্য হন। তার ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে ১৪ দলের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়। মেনন বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে চিঠির জবাব দিয়েছেন। মেননের এমন এক সময় এই বক্তব্য দিলেন যখন ক্যাসিনো থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। ক্যাসিনোকাণ্ডে নাম আসায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে এমন আলোচনাও ছিল। এ অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য দিয়ে বেকায়দায় পড়া মেনন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও কথা বলে বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন বলে সূত্রের দাবি। একটি সূত্র জানায়, সরাসরি যোগাযোগ করতে না পেরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে যোগযোগ করেন মেনন। তিনি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেয়ার পাশাপাশি দুঃখ প্রকাশ করেন। এদিকে, ক্ষমতাসীন দল ও জোটকে দুঃখ প্রকাশের মাধ্যমে সন্তুষ্ট করতে পারলেও নিজের দলের ভাঙন ঠেকাতে পারছেন না রাশেদ খান মেনন। পলিটব্যুরোর সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিমল বিশ্বাস দল ছাড়ার পর আরও ছয় কেন্দ্রীয় নেতা দলের আসন্ন কংগ্রেস বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। এই ছয় নেতা হলেন, পলিটব্যুরো সদস্য নুরুল হাসান ও ইকবাল কবির জাহিদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জাকির হোসেন হবি, মোফাজ্জেল হোসেন মঞ্জু, অনিল বিশ্বাস ও তুষার কান্তি দাস। গতকাল এই ছয় নেতা এক বিবৃতিতে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ভিন্নমতের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। নেতারা জানিয়েছেন, সাড়ে ছয়শ কাউন্সিলর নিয়ে আসন্ন কংগ্রেস হওয়ার কথা। এর মধ্যে এক থেকে দেড়শ কাউন্সিলর কংগ্রেস বর্জন করবেন। তাদের নিয়ে পরবর্তীতে নতুন দল গঠন করা হতে পারে। দলের নাম কি হবে এটি চূড়ান্ত না হলেও ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী)।
চীনপন্থি কয়েকটি কমিউনিস্ট পার্টি এক হয়ে ১৯৯২ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি গঠনের পর এ নিয়ে তৃতীয় দফায় বড় ভাঙনের মুখে রয়েছে দলটি। এর আগে সাইফুল হক আলাদা দল গঠন করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধার পর হায়দার আকবর খান রনোর নেতৃত্বে কয়েক জন পার্টি ছেড়ে সিপিবিতে যোগ দিয়েছিলেন। এদিকে, কংগ্রেস বর্জনের ডাক দেয়া ছয় নেতা এক বিবৃতিতে বলেন, ১৯৯২ সালের ৪ঠা মে ঐক্য কংগ্রেসে গৃহিত মতাদর্শগত, নীতি-কৌশল থেকে পার্টি ক্রমান্বয়ে দক্ষিণপন্থী, বিলোপবাদী ধারায় অধঃপতিত হয়েছে। ঐক্য কংগ্রেসের লক্ষ্য ছিল কমিউনিস্ট ঐক্যকে এগিয়ে নেয়া এবং বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামই হবে পার্টির ভিত্তিমূলক কাজ। পার্টির বর্তমান নেতৃত্ব ঐক্য কংগ্রেসের মতাদর্শগত নীতি-কৌশল ও সংগঠন সম্পর্কে গৃহিত ভিত্তি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে।
তারা বলেন, ইতোমধ্যে পার্টি তার সংগ্রামী ভাবমূর্তি হারিয়ে ফেলেছে, দল জনগণ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। পার্টি ও তার গণসংগঠন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ১৪ দলের সঙ্গে কর্মসূচি ভিত্তিক ঐক্য, হাতুড়ি ছেড়ে নৌকা মার্কায় নির্বাচন এবং সরকারে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের মাধ্যমে পার্টির নীতি আদর্শকে জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে। এই ভ্রান্তনীতির অনুসরণের ফলে পার্টির অগণিত নেতা, কর্মী এবং জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
এতে বলা হয়, বরিশালের জেলা সম্মলনে দলের কর্মী এবং জনগণের দাবির মুখে ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের প্রহসনের নির্বাচন সম্পর্কে পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন যে সত্য উচ্চারণ করেছিলেন, পরদিন তার ইউটার্ন পার্টি অনুসৃত বর্তমান রাজনীতিরই অনিবার্য ফল। ওয়ার্কার্স পার্টি বর্তমানে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে সুবিধাবাদী পার্টিতে পরিণত হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আজ রাজনৈতিক দুর্নীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক দুর্নীতিতেও আক্রান্ত। বাস্তবতার নামে বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তির রাজনৈতিক লাইন ও জোটনীতি তথা আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্থায়ী ঐক্যের যে নীতি-কৌশল গ্রহণ করে চলেছে তাতে ওয়ার্কার্স পার্টি দেউলিয়া পার্টিতে পরিণত হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, লাল পতাকাকে সমুন্নত রাখতে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদকে পরাস্ত করে সত্যিকারের বিপ্লবী পার্টি, কমিউনিস্ট ঐক্য, বাম-গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়ে তুলতে সব পার্টি কমরেডদের এই প্রহসনের কংগ্রেসে অংশগ্রহণ না করার আহ্বান জানাচ্ছি।
মেননের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট ১৪ দল: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে ১৪ দল। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে দলটির মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের বাসায় ১৪ দলের বৈঠক শেষে এ তথ্য জানানো হয়। সাংবাদিকদের মোহাম্মদ নাসিম বলেন,সমপ্রতি বরিশালে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি মেনন সাহেবের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়ে ১৪ দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা একটি চিঠি দিয়েছিলাম। তিনি রোববার চিঠিতে বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার কাছ থেকে যে ব্যাখ্যা পেয়েছি তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তিনি বলেন,আমরা বিশ্বাস করি ১৪ দল একটা আদর্শিক জোট। অসামপ্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমি বলতে চাই, তার ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে এই বিতর্কের অবসান হতে যাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি ১৪ দল রাশেদ খান মেননসহ অন্যান্য শরিক দল নিয়েই অতীতে যেভাবে কাজ করেছি সেভাবেই কাজ করে যাব। এদিকে জোটের কাছে পাঠানো চিঠিতে নিজের বক্তব্যকে গণমাধ্যমে ভুলভাবে এসেছে বলে দাবি করেন রাশেদ খান মেনন। মোহাম্মদ নাসিমকে উদ্দেশ্যে করে চিঠিতে তিনি বলেন, বরিশালে ঐ বক্তৃতায় নির্বাচনে জনগণের অনুৎসাহ, ভোটার অনুপস্থিত সম্পর্কিত বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রসঙ্গত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে কথা বলেছি তাতে অতিশয়োক্তি ঘটায় এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। আমার বক্তব্যের খন্ডিতাংশ উদ্বৃত হওয়াতে ঐ বক্তব্যের ভিন্ন অর্থ দাঁড়িয়েছে। বরিশালের বক্তব্য নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছি। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, রাশেদ খান মেননের ব্যাখ্যা নিয়ে ১৪ দলের বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আলোচনার প্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, তিনি ১৪ দলের জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে মতামতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তিনি ১৪ দলের নির্বাচন সংক্রান্ত বিশ্লেষণের সঙ্গে সম্পূর্ণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, ১৪ দলের কাছে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন,সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস প্রমুখ।