বদিউল আলম মজুমদার, ঢাকা:চলতি মাসের ১১ তারিখে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের সময় উপাচার্য বুয়েটে ছাত্র ও শিক্ষকরাজনীতি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন, যদিও ১৯৬২ সালের দ্য ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে, ক্যাম্পাসে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ারই কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত বুয়েটের এখতিয়ার বলে স্বীকৃতি দিলেও তিনি সারা দেশে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অনেক রাজনৈতিক দলও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ না করার পক্ষে। এমনকি ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের মধ্যেও ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিরুদ্ধে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে।
রাজনীতিবিদদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে। তাঁদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থে ছাত্রদের অপব্যবহার করছে। বিদ্যমান আইনও ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে—সংসদ আইন করে রাজনৈতিক দলে অঙ্গসংগঠন হিসেবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে, তবু ছাত্ররাজনীতি চলছেই।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)-এর ৯০ বি (১) (খ) (iii) অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিবন্ধিত হতে চাইলে তাদের গঠনতন্ত্র থেকে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অথবা ছাত্র অথবা আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী অথবা শ্রমিক অথবা পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থাকার বিধান’ বিলুপ্ত করতে হবে। তবে এ বিধানের ফলে ‘তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়ার কিংবা সংগঠন, সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদি গঠন করার এবং সকল প্রকার গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চা ও প্রয়োগ করার এবং ব্যক্তি হিসেবে, বিদ্যমান আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে, রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।’ [প্রসঙ্গত, আরপিও-এর ৯০ সি (১) (ঙ) ধারাতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বিদেশি শাখা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ওপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।]
স্মরণ করা যেতে পারে যে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে পরিচালিত সংলাপ ও ঐকমত্যের ভিত্তিতেই অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০০৮ সালে আরপিওতে ৯০বি ও ৯০সি ধারাদ্বয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নবম জাতীয় সংসদ প্রথম অধিবেশনেই অধ্যাদেশটিকে অনুমোদনের মাধ্যমে আইনে পরিণত করে। প্রসঙ্গত, আজকে যাঁরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই ২০০৯ সালে আইনটি পাসের সময় সংসদ সদস্য ছিলেন।
এটি সুস্পষ্ট যে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মতো অঙ্গসংগঠন সৃষ্টি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে এর মাধ্যমে ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক ও পেশাজীবীদের রাজনীতি ও সংগঠন করার অধিকার খর্ব করা হয়নি। খর্ব করা হয়নি ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রছাত্রীদের সংঘবদ্ধ হওয়ার এবং জাতির ক্রান্তিলগ্নে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের সুযোগ। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো আইন লঙ্ঘন করে ছাত্রদের নিয়ে তাদের লেজুড় সংগঠন পরিচালনা করেই চলেছে, যার পরিণতিই বুয়েটে সনি ও আবরার হত্যাকাণ্ড এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতন সেলের অস্তিত্ব। তাই বুয়েট কর্তৃপক্ষের ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত বুয়েট সৃষ্টির সময়কার অধ্যাদেশ ও রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইন প্রয়োগ করারই একটি পদক্ষেপ মাত্র।
উল্লেখ্য, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো একটি অনৈতিক ‘খেলার’ মাধ্যমে সংসদে পাস করা আইনটির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আসছে। তারা তাদের গঠনতন্ত্র থেকে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিধান বিলুপ্ত করে বিদ্যমান লেজুড় সংগঠনগুলোকে ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ সংগঠন বলে আখ্যায়িত করে এগুলো একইভাবে পরিচালনা করে চলছে। এমনকি তাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বও নির্ধারণ করে দিচ্ছে, যেমনিভাবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ছাত্রলীগের নেতৃত্ব পরিবর্তন করে দিয়েছেন। অর্থাৎ ছাত্ররাজনীতির বীভৎসতা নগ্নভাবে উন্মোচিত এবং ছাত্রদের ব্যবহারের রাজনীতি বন্ধের ব্যাপারে সারা দেশে একটি ঐকমত্য বিরাজ করলেও আমাদের রাজনীতিবিদেরা ছাত্ররাজনীতি অবসানের আরপিওর নির্দেশনা উপেক্ষা করেই চলেছেন।
রাজনৈতিক দলের যুক্তি হলো, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে শিক্ষাঙ্গনে অপশক্তির বিস্তার ঘটবে। তবে রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ছাত্ররা আজ যেসব অপকর্ম করছে, তাতে অনেকের মতে তারাই এখন অপশক্তিতে পরিণত হয়েছে। আর তারা তাদের অপকর্ম বন্ধ না করলে ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী অপশক্তির উত্থান ঠেকানো যাবে না বলেও অনেক বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তাদের আরেকটি যুক্তি হলো ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে তাকালে এ যুক্তির অসারতা অতি সহজেই উপলব্ধি করা যায়। এ ছাড়া ছাত্রদের মধ্যকার বিরাজমান দ্বন্দ্ব ও হানাহানির রাজনীতি জাতির দুঃসময়ে তাদের সংঘবদ্ধ হতে বাধাগ্রস্তই করবে। আর ছাত্ররাই যদি দলীয় রাজনীতি করবে, রাজনীতিবিদেরা করবেন কী?
আজ আমাদের দেশে ছাত্ররাজনীতির মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষাঙ্গন ও রাজপথ দখলে রাখার লক্ষ্যে ছাত্রদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা। তাই তো আমরা খালেদা জিয়াকে অতীতে বলতে শুনেছি, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তাঁর ছাত্রদলই যথেষ্ট। আর এর সাম্প্রতিক প্রয়োগ আমরা দেখেছি শিশুদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ে। তাই এটি সুস্পষ্ট যে ছাত্ররাজনীতি আজ আর ছাত্রদের স্বার্থে ‘অর্গানিকালি’ বা আপনা থেকে গড়ে উঠছে না এবং পরিচালিত হচ্ছে না বরং পৃষ্ঠপোষক দলের স্বার্থেই তা চলছে। আর্থিক ও পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই—তারা ‘মাদার’ দলের নির্দেশনায়ই পরিচালিত হয়।
বিদ্যমান ছাত্ররাজনীতি মূলত একটি ‘প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট’ বা দাতা-গ্রহীতার সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিচালিত। ছাত্ররা এ ক্ষেত্রে গ্রহীতা—তারা দাতার স্বার্থে কাজ করে এবং তার বিনিময়ে নানা সুযোগ-সুবিধা এবং বহু ক্ষেত্রে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে। এমন পৃষ্ঠপোষকতা, বিশেষত সরকারি দলের ক্ষেত্রে, যা তাদের প্রায় সব ধরনের অন্যায়, অনেক ক্ষেত্রে দলবাজ শিক্ষকদের সহায়তায়, বিনা বাধায় বা ‘উইথ ইম্পিউনটি’ করার সুযোগ করে দেয়। বস্তুত আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে ছাত্ররাজনীতিকে আজ ‘অস্ত্রে’ পরিণত করে ফেলেছে, যা আমাদের কোমলমতি ও মেধাবী ছাত্রদের দানবে পরিণত করছে।
ছাত্ররাজনীতির কারণেই আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ এখন চরমভাবে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে এবং এগুলো সন্ত্রাস ও সহিংসতার জনপদে পরিণত হয়েছে, যা আমাদের দণ্ডবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। দণ্ডবিধির ১৫২খ ধারা অনুযায়ী, ‘যে কেউ উচ্চারিত বা লিখিত কোনো কথা দ্বারা অথবা দৃশ্যমান কোনো প্রতীক দ্বারা বা অন্য কোনোভাবে কোনো ছাত্রকে বা ছাত্রগোষ্ঠীকে অথবা ছাত্রদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা ছাত্রদের ব্যাপারে আগ্রহান্বিত কোনো প্রতিষ্ঠানকে কোনোরূপ রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে প্ররোচনা দান করে, যা জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত বা ক্ষুণ্ন করে অথবা বিঘ্নিত বা ক্ষুণ্ন করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে, সে দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড বা জরিমানা দণ্ড বা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’
আরপিও ও দণ্ডবিধি প্রয়োগ না হওয়ার চড়া মূল্য জাতিকে দিতে হচ্ছে। স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে আমাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে ১৫১টি প্রাণ অকালে ঝরে পড়েছে। আবরার ফাহাদের অকালমৃত্যু বহুলাংশে আমাদের আইনের শাসনের অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিরই ফসল।
পরিশেষে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছাত্ররাজনীতি বন্ধ আমাদের শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা ও অন্যান্য অপকর্মের অবসান ঘটাবে না। এর জন্য প্রয়োজন হবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা না করার অঙ্গীকার। এর জন্য আরও প্রয়োজন হবে অসহিষ্ণুতা ও নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতির অবসান এবং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন। এ ছাড়া প্রয়োজন হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান। একই সঙ্গে প্রয়োজন হবে আমাদের নির্বাচন কমিশনের আরপিও প্রয়োগের লক্ষ্যে অনমনীয়তা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক