ঢাকা: পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কার্যালয়ে গত ২৪ সেপ্টেম্বর এক কর্মকর্তার ডেস্কে গিয়ে এসএমইসি প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা মুখ তুলে একটু বক্র হাসি দিয়ে বললেন, ‘ও আচ্ছা, মিছামিছি প্রকল্পের কথা জানতে চান?’
মিছামিছি প্রকল্প? প্রথম ধাক্কায় বুঝতে কষ্ট হলেও খোঁজখবর করতে গিয়ে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হলো এসএমইসি প্রকল্পটিকে আইএমইডির অনেকে কেন ‘মিছামিছি’ প্রকল্প বলে ডাকে।
স্ট্রেনদেনিং মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন ক্যাপাবিলিটিজ অব আইএমইডি (এসএমইসি) প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে ‘আইএমইডির সক্ষমতা বাড়ানো’র উদ্দেশ্যে। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন পায়। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা পারেনি আইএমইডি। ৭১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত করা হয়। তাতেও শেষ না হলে আরো দুই দফা ২০১৮ সালের জুন ও ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। তাতেও না হলে আবারও প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৫৭ কোটি টাকা। এ তথ্য জানা গেল প্রথমবার ‘মিছামিছি’ নামটি শোনা গিয়েছিল যে কর্মকর্তার কাছ থেকে তিনিসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে। তাঁদের অনুরোধেই কারো নাম লেখা হলো না।
২০১৬ সালে জারি করা ‘সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধনী’ পরিপত্রের দুই নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘কোনো প্রকল্পের মেয়াদ দুইবারের বেশি বাড়ানো যাবে না।’
সরকারের ৫৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে এই নিয়মনীতি শেখানো এবং তা মানতে বাধ্য করাই আইএমইডির কাজ, অথচ নিজেরাই সেটা মানছে না।
প্রকল্প প্রস্তাব (পিপি) সংগ্রহ করে দেখা গেল, প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য বলা হয়েছে এমন একটি সফটওয়্যার তৈরি করা, যেখানে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় সারা দেশে চলমান দেড় হাজারেরও বেশি প্রকল্পের হালনাগাদ তথ্য থাকবে। কোন প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি কতটুকু, প্রত্যেক প্রকল্প পরিচালক তার সঠিক তথ্য ওই সফটওয়্যারে সংরক্ষণ করবেন। সরকারের নীতিনির্ধারকসহ যে কেউ চাইলে প্রকল্পের হালনাগাদ তথ্য জানতে পারবেন।
এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কিভাবে একটি প্রকল্প দেখতে হয়, তা শেখাতে এই প্রকল্পের আওতায় আইএমইডির শতাধিক কর্মকর্তাকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, চীন, নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প নজরদারিতে গতি আনতে ছয়টি জিপ গাড়ি কেনা হয়েছে, যার একেকটির দাম ছিল ৭৫ লাখ টাকা করে।
ছয় বছরে প্রকল্পের কতটুকু অগ্রগতি হলো এবং আইএমইডির সক্ষমতা কতটা বেড়েছে তা দেখতে আইএমইডির কর্মকাণ্ডের ওপর মাসখানেক ধরে অনুসন্ধান করে জানা গেল, সারা দেশে চলমান এক হাজার ৬০০টি প্রকল্পের হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণের জন্য যে সফটওয়্যার তৈরি করার কথা, তা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। গত ছয় বছরে মাত্র ৬১৩টি প্রকল্পের হালনাগাদ তথ্য প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম নামের পিএমআইএস সফটওয়্যারে এন্ট্রি করা হয়েছে। এখনো ৯৮৭টি প্রকল্পের হালনাগাদ তথ্য সংযোজন বাকি আছে। মেয়াদ বাড়াতেই ইচ্ছা করে প্রকল্পটির গতি শ্লথ করার অভিযোগ আছে। চতুর্থবারের মতো প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রধান কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, আগামী এক বছর প্রকল্প পরিচালকদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, তাই।
আইএমইডির কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রকল্প মূল্যায়নের কৌশল শেখাতে বিদেশ সফর বাবদ বরাদ্দ রাখা ছিল ২১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। নথি ঘেঁটে দেখা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় ২৯৩ জন কর্মকর্তাকে স্থানীয় ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কাউকে কাউকে এক বছরের মাস্টার্স কোর্স করিয়েছে সংস্থাটি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, আইএমইডির সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রকল্পের সঠিক মূল্যায়ন করতে যাঁরা প্রশিক্ষণের জন্য দেশের বাইরে গেছেন, তাঁদের অনেকেই এখন আইএমইডিতে নেই। বদলি হয়ে চলে গেছেন অন্য মন্ত্রণালয়ে। আইএমইডির সহকারী পরিচালক শাহিনা সুলতানার পেছনে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে তাঁকে এক বছরের মাস্টার্স পড়তে দেশের বাইরে পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল, প্রকল্প মূল্যায়নসহ তিনি যা শিখবেন তা দেশে এসে কাজে লাগাবেন। কিন্তু বিদেশ থেকে শিখে আসা জ্ঞান কাজে লাগানোর আগেই তাঁকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় যাঁরা বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখন আইএমইডিতে নেই। ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ নেওয়া সিনিয়র সহকারী সচিব উপমা আক্তার চলে গেছেন পরিকল্পনা কমিশনে। ১৪ দিনের প্রশিক্ষণ নেওয়া সিনিয়র সহকারী সচিব মানস মিত্র, সহকারী সচিব কাউসার আলম এখন আইএমইডিতে নেই। এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ যাওয়া ফারজানা হোসেন বদলি হয়ে চলে গেছেন অন্য মন্ত্রণালয়ে। প্রশিক্ষণ নেওয়া সিনিয়র সহকারী সচিব নজরুল ইসলামসহ অনেকেই এখন অন্য মন্ত্রণালয়ে। হাতে গোনা কয়েকজন যাঁরা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁরা এখন আইএমইডিতে আছেন। বেশির ভাগই নতুন কর্মকর্তা।
আইএমইডির কর্মকর্তাদের প্রকল্প পরিদর্শনে সহজে যাতায়াতের জন্য ছয়টি জিপ কেনা হয়েছে ২০১৩ সালে। প্রগতি থেকে কেনা একেকটি জিপের দাম ৭৫ লাখ টাকা। সরেজমিনে দেখা গেল, গাড়িগুলো রাজধানীর শেরেবাংলানগরে আইএমইডির কার্যালয়ের সামনে পড়ে আছে। জনগণের করের টাকায় কেনা গাড়িগুলো যত্ন করার কেউ নেই। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় ময়লা-আবর্জনা পড়ে গেছে। আউটর্সোসিংয়ে নিয়োগ পাওয়া গাড়িচালক আমির হোসেন (এখন অন্য একটি সরকারি সংস্থায় কাজ করছেন) বললেন, গাড়িগুলোর ভেতরের অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করতে বহু টাকা খরচ করতে হবে।
জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব আবুল মনসুর মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ গত মাসে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এই দপ্তরে আসার অনেক আগেই প্রকল্পটি অনুমোদন হয়েছিল। এই প্রকল্পের বেশ কিছু কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ করতেই প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানো হয়েছে।’ ছয়টি জিপের ভবিষ্যৎ কী এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা আগামী এক বছরে গাড়িগুলো রাজস্ব খাতে নেওয়ার চেষ্টা করব।’
প্রকল্পের মেয়াদ কেন চারবার বাড়ানো হলো এবং কেন গত ছয় বছরে গাড়িগুলো রাজস্ব খাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়নি জানতে চাইলে গত মাসে প্রকল্প পরিচালক হাবিবুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’