ঢাকা: সম্প্রতি বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নাড়া দিয়েছে সারা দেশের মানুষকে। দলমত নির্বিশেষে কাঁদিয়েছে সবাইকে। আবরারের জন্য কেঁদেছে পুরো দেশ। আবরারের খুনিদের বিচারের দাবিতে চলা আন্দোলনের মধ্যেই গতকাল হয়ে গেল বুয়েটের
ভর্তি পরীক্ষা। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত দুই ধাপে এ পরীক্ষায় অংশ নেন ১২ হাজার শিক্ষার্থী। এসেছিলেন কয়েক হাজার অভিভাবক। আবরারের খুনীদের শাস্তির দাবিতে চলা আন্দোলনে বুয়েট ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে এখন শুধু আবরারের ছবি। নির্মম নির্যাতনের শিকার জীবন হারানো আবরারের এই মুখ দেখে গতকালও কেঁদেছেন হাজারো মানুষ।
পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অনেকে হয়েছেন আবেগ আপ্লুত।
আবরারের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এক পরীক্ষার্থীর মা। তিনি বলেন, আমার মেয়ে মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে পাশ করেছে। তাকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে এসেছি। ওর সঙ্গে আবরারের বিষয়ে খুব একটা আলোচনা করিনি। ঘটনার পরে সবাইতো আমরা ওর জন্য কেঁদেছি। এখন মনে হয় ও যেন আমাদের সবার নিজেদেরই ‘আবরার’। এখন সে আমাদেরই। আমি ওর মা হলে বলতাম, আবরারকে যেভাবে মারা হয়েছে ওদেরকে যেন ঠিক একইভাবেই মারা হয়। তাহলে ওরা বুঝবে যে আবরার কতটুকু কষ্ট পেয়ে মরেছে। ওই মূহুর্তে ওর কত কষ্ট হয়েছে। অন্যভাবে মরলেতো ওরা আবরারের মৃত্যুর কষ্ট বুঝবে না। এটা নিয়ে এতো আলোচনা সমালোচনার কিছু নেই। আবরারের আরেক মা হিসেবে আমি বলবো, আবরারের মত করেই খুনিদের মারা হোক। আবরারও নেই। কাজেই ওরাও থাকবে না। আবরারের তো কোনো দোষ ছিল না। ও কোনো দোষ না করে যেহেতু নেই। তাহলে দোষ করে ওরা কেনো থাকবে। ওদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। ওরা বেঁচে থেকে আবার কোনো নিরপরাধ মানুষকে থেকে থেকে মারবে। এটা তো হয় না। এক পরীক্ষার্থী কান্না করে বলেন, আবরার হত্যার ঘটনায় আমি অনেক কেঁদেছি। এখানে এসে আমি আর মা দেয়ালের গ্রাফিতি দেখে কেঁদেছি। আজ হয়তো সে বেঁচে থাকলে পরিবেশটা অন্যরকম হতো। আমরা চাই, আবরারের নামে একটি হল তৈরি করা হোক। যেটার নাম থাকবে ‘শহীদ আবরার হল’। মা-বাবা আমাকে কোনো মোবাইল ফোন দেখতে দেয়নি। মোবাইল সবসময় তাদের কাছে রেখেছে। এগুলো দেখে মন মানসিকতা খারাপ হয়ে গেলে হয়তো পরীক্ষা খারাপ হতে পারে।
একজন পরীক্ষার্থী সঙ্গে আসা তার বোন বলেন, আমি গাজিপুরে জয়দেবপুর গভ. গার্লস হাইস্কুলে পড়ি। ভবিষ্যতে এখানে পড়তে চাই। তাই ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে এসেছি। ক্যাম্পাস ভালো লেগেছে। আবরার ভাইয়াকে যেভাবে মারা হলো এবং তাকে যারা মেরেছে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিৎ দ্রুততম সময়ের মধ্যে। পরীক্ষা দিতে আসা এক পরীক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, আমরা স্বীকার করি আর না করি বুয়েট প্রশাসন তো আসলেই খারাপ। একটি ভালো শিক্ষার্থীকে শুধুমাত্র পড়া দিয়ে আটকালে হবে না। পাশাপাশি তাকে অনেক কিছু শিখাতে হবে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে নিয়ে যে সকল মন্তব্য করা হচ্ছে ভিসি তো আসলেই তাই। একজন পরীক্ষার্থীর ব্যাংকার বাবা বলেন, আমার ছেলে পরীক্ষা দিতে এসেছে। সে যদি চান্স পায় তাহলে এখানেই ভর্তি করাবো। আমার বিশ্বাস যে এর একটি সঠিক বিচার হবে। সঠিক বিচার হলে ছাত্ররা এখানে নিরাপদে পড়ালেখা করতে পারবে। বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে রাজনীতি নেই এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বুয়েট ছিল অন্যতম। এখানে নেই কোনো সেশন জট। শিক্ষার্থীরা তাদের পড়ালেখা শেষ করে চার বছরের মধ্যে কৃতিত্বের সঙ্গে ভালো ফলাফল করে বের হয়ে যাচ্ছে। বাকী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে অপরাজনীতি রয়েছে সেখানে সবসময় একটি টেনশন কাজ করে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে। আমার মনে হয়, সারা বাংলাদেশে সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সব ধরনের রাজনীতি বন্ধ করে দেয়া উচিৎ। এখন ছাত্র রাজনীতি মানে ক্যাম্পাসের হলে বসে মদ, গাজা খাচ্ছে। জুয়া খেলছে। নানা ধরনের অঘটন ঘটাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উপর টর্চার করছে। পড়ালেখার পরিবেশ নষ্ট করছে। বাংলাদেশের সেরা মেধাবী ছাত্রগুলো বুয়েটে পড়ে। সেই বুয়েটে আমরা জীবন্ত ছেলেকে পড়তে দিচ্ছি আর তার মৃত লাশ এখান থেকে নিতে হচ্ছে। উত্তরা রাজউক কলেজের শিক্ষার্থী এবং বুয়েটের পরীক্ষার্থী বলেন, আবরার হত্যাকাণ্ডে খুনিদের গ্রেপ্তার করার পর মনে হয়েছে, এখন মনে হয় এখানে (বুয়েটে) পড়া যাবে। নিরাপদে পড়তে পারবো। এর আগের পরিবেশ সম্পর্কে ভালো জানা ছিল না। তবে আবরার হত্যাকাণ্ডের কারণে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়েছিল। আমরা চাই আবরার হত্যাকারিদের উপযুক্ত শাস্তি হোক। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে পাস করা একজন শিক্ষার্থী বলেন, আবরার ভাই যে হলে থাকতেন সেই শেরে বাংলা হল দেখতে গিয়েছিলাম। অনেক খারাপ লেগেছে। কান্না পেয়েছে। আইটি ফার্মে কর্মরত এক নারী অভিভাবক বলেন, আমার ছোট বোন মিরপুর হারম্যান মেইনার কলেজ থেকে পাস করেছে। আবরার হত্যাকাণ্ডের পর আমরা ওর পরীক্ষা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। বুয়েটের মতো যায়গায় শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে এমন ঘটনা ঘটাতে পারে সেটা জানা ছিল না।