আনোয়ারা আল্পনা
কখনো বাস চাপা দিয়ে মেরে ফেলবে, কখনো নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে। আমরা আবরারদের জন্য এই বাংলাদেশই গড়ে তুলেছি।
এখানে সকাল হলেই, আমাদের শুনতে হবে এসব অসহ্য মৃত্যুর খবর। আর তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে চেনাজানা কেউ, এটা শুনেই ক্ষোভে ফেটে পড়ব না, আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে, কেন মেরেছে, যথেষ্ট সংগত কারণ আছে কি না। দেশের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে ফেসবুকে সে যে কথা লিখেছে, তা কতটা ‘শিবিরগন্ধী’ সেটা না জেনে কাঁদতেও পারা যাবে না। তার ফেসবুকে ঢুকে আমাদের দেখতে হবে, কতটা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কথা সে বলে ফেলেছে। আর তারপরেই কেবল আমাদের মনে হতে থাকে, যে দেশে তারা বাস করবে, সে দেশ নিয়ে সামান্য কথা বলার অধিকারও নেই তাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা একটা ছেলে খুন হলে একটা দেশের আসলে কী হয়?
প্রথমেই আমাদের মনে পড়ে তার মায়ের কথা। একজন সন্তান বড় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠানোর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া এই দেশে কী বিরাট যুদ্ধ, সেটাই মনে পড়ে আমাদের। আর যে ছেলে দেশের সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে, তাকে কতটা যুদ্ধ করতে হয়েছে আর সেই যুদ্ধ এভাবে শেষ হয়েছে, ভাবতেও দম বন্ধ হয়ে আসে না?
কিন্তু আসলে এসব কিছুই নয়, মা কেবল ভাবছেন, কতটা কষ্ট দিয়ে মেরেছে ছেলেকে, তাঁর নিজের হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা শরীর, কতভাবে, কতক্ষণ ধরে মেরে মেরে রক্তাক্ত করেছে তারা? আবরার কি বারবার মা মা বলে ডেকেছিল? পানি কি খেতে চেয়েছিল?
হয়তো কেবলই মনে পড়ছে একটু শাসনের প্রহারেও মায়ের বুকে কতটা ক্ষরণ হয়েছে। হয়তো কেবলই মনে পড়ছে, পরীক্ষা বলে ছুটির মধ্যে ছেলেকে নিজের হাতে ঘুম থেকে তুলে পাঠিয়ে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবরারের আরও একটি ভাই রয়েছে। মা কি এখন সরকারের দুয়ারে এই বলে মাথা খুঁটবেন, অন্তত আরেকটা ছেলে যেন বেঁচে থাকে, তার আর লেখাপড়ার দরকার নেই, শুধু সে বেঁচে থাকুক, মায়ের কাছে থাকুক? আবরারের বাবার জোড়হাত কেঁদে কেঁদে তা-ই বলছে না?
একটা পরিবার বাকি জীবন ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে কোনোরকমে হয়তো বেঁচে থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশকে এই মৃতদেহ আগলে বসে থাকতে হবে।
ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় এই দেশের প্রতিটি কোনায় কি পরিমাণ অত্যাচার চলে, সেটা প্রতিদিন আমরা টের পাই না? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্রতিদিনই চলে ক্ষমতার দাপট। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ বছর আগে, সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা ধর্ষণের সেঞ্চুরি করেছিল। দিনের পর দিন আন্দোলন করে শুধু তাদের ছাত্রত্ব বাতিল করা গিয়েছিল, দেশের প্রচলিত আইন তাদের কিছুই করেনি।
সাবেকুন নাহার সনি খুন হয়েছিল যখন, তখনো উত্তাল হয়ে উঠেছিল বুয়েট। ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় এসব খুনের ক্ষেত্রে কী ঘটে দেখছি আমরা। আবরারের মা-বাবা যদি বলেন, ছেলে হত্যার বিচার চাই, তাহলে আবারও তাঁদের সেই যুদ্ধই করতে হবে, যতটা তাঁরা করেছেন ছেলেকে ২২ বছরের মেধাবী তরুণ তৈরি করতে।
আমরা কি জানি না, এই খুনের জন্য সরকার যদি তার নিজের ছেলেদের একজনকেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হতে দেয়, সেটাই অনেক? আমরা কি যুগে যুগে তাই দেখিনি?
দেশকে ডুবে যেতে দেখতে দেখতে যখন একটা পরাজিত প্রজন্ম দায়িত্ব চাপিয়ে দেয় পরের প্রজন্মের কাঁধে, ভাবে যে ওরা দেশকে ঠিকঠাক করতে পারবে। সড়ক আন্দোলনের সময় আমরা চোখ পিটপিট করে বলেছিলাম, ওই যে ওরা দেশ মেরামত করতে নেমে গেছে, আমাদের আর চিন্তা নেই। যুগের পর যুগ ধরে যে ক্লেদের পাহাড় গড়ে তুলেছে কয়েকটা অযোগ্য প্রজন্ম তারাই, সে জগদ্দল পাহাড় ঢেলে সরিয়ে দেওয়ার জন্য শিশু-কিশোরদের আন্দোলনে হাততালি দিয়েছে। ওরা মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়েছে, আর ফের দেশ চলেছে আগের থেকেও খারাপভাবে। আমরা তো তারাই, যারা শিশু ধর্ষণের প্রতিবাদের ব্যানার ঝুলিয়ে দিই শিশুরই গলায়। যেন আমরা তোমাদের এই দেশে এনেছি, এখন এটা একটা পচাগলা দেশ হলে আমাদের কী করার আছে?
নিজেদের লেখাপড়া ফেলে, সরকারি ছাত্রসংগঠনের হাজারটা নির্যাতন সামলে, সরকারের মনোনীত ভিসি নামের রাক্ষসদের যাবতীয় জুলুম সহ্য করার পর তাদের কথা বলতে হচ্ছে দেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও। তারা তো জানেই এই দেশের সিদ্ধান্ত যারা নেয়, তাদের কাছে এটা একটা গদিই কেবল। গদিতে থাকতে তাদের নদী, বন, গ্যাস সবই দিতে হয় পরাক্রমশালী প্রতিবেশীকে। গদি মজবুত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে হয় মেরুদণ্ডহীন, সরকারের তাঁবেদার ভিসি। নিজেদের আর বিশেষ ছাত্রদের স্বার্থ ছাড়া যাঁরা আর কিছুই দেখেন না। বুয়েট নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও ছাত্র হত্যার খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে সেখানে যাননি। আবরার মরে গিয়ে তাঁকে বিপদেই ফেলেছেন।
আর আমরা এই বাংলাদেশের আমজনতা, নিজেদের সন্তান বুকে জাপটে ধরে ভাবতে থাকি, লেখাপড়া দরকার নেই, শুধু বেঁচে থাক।
আনোয়ারা আল্পনা: গল্পকার।