ঢাকা: আবরার যেই রুমে থাকতেন সেই ১০১১ নম্বর রুমে কেউ নেই। ওই রুমের বাকি তিন শিক্ষার্থী ১০১০ নম্বর রুমে অবস্থান নিয়েছেন। আবরারের টেবিলে একটি খাতা খোলা রয়েছে। খাতার ওপর একটি কলম রয়েছে। একটি অঙ্ক অর্ধেক করে রাখা হয়েছে। আর যেই রুমে আবরারকে হত্যা করা হয়েছে সেই ২০১১ নম্বর রুমে একটি বিছানার ওপর দড়ি পাওয়া যায়। এরপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে স্ট্যাম্প, লাঠি ও মদের কিছু খালি বোতল। পরে পুলিশ সেগুলো উদ্ধার করে নিয়ে যায়। ওই রুমে থাকতেন ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহা, মুজতবা রাফিদ, ইফতি মোশাররফ সকালসহ আরো একজন। গতকালের খুব সকালের চিত্র এটি।
একটি ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে শিবির সন্দেহে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। আবরার ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। গতকাল সোমবার ভোরে বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে উদ্ধার করা হয় তাঁর লাশ। ঘটনার পর থেকে বুয়েটে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে শেরেবাংলা হলে অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১৯ জনকে শনাক্ত ও ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গতকাল রাত ৮টার দিকে আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। চকবাজার থানার ওসি আলী হোসেন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ওসি কালের বলেন, আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ ও প্রাথমিক তদন্ত শেষে অন্যদেরও শনাক্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আবরার গত শনিবার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। পরে সেটি ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক মুন্নার নজরে আসে। তিনি একই হলের শিক্ষার্থী বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকারকে বিষয়টি জানিয়ে আবরারকে ডেকে আনার নির্দেশ দেন। তাঁরা সবাই ১৬ ও ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী।
নেতাদের কক্ষে নেওয়ার পর আবরারের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নেওয়া হয়। তার ফেসবুক মেসেঞ্জার চেক করাসহ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর শুরু হয় মারধর। একপর্যায়ে আবরার অচেতন হয়ে পড়লে কোলে করে মুন্নার ২০০৫ নম্বর কক্ষে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার আরো অবনতি হলে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মধ্যবর্তী জায়গায় অচেতন আবরারকে নিয়ে যান তাঁরা। এরপর হল প্রভোস্ট ও চিকিৎসককে খবর দেওয়া হয়। চিকিৎসক এসে আবরারকে মৃত ঘোষণা করেন। তখন কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দেয়।
বুয়েট ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু আটক হওয়ার আগে গতকাল সকালে বলেন, ‘আবরারকে শিবির সন্দেহে রাত ৮টার দিকে ১৭ ব্যাচের ছাত্রলীগের সদস্য মুন্তাসির আল জেমি ও এহতেশামুল রাব্বি তানিম ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে আনেন। সেখানে তাঁর মোবাইলে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার চেক করে বিতর্কিত কিছু পেইজে তাঁর লাইক দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।’
সূত্র জানায়, শেরেবাংলা হলে প্রায়ই শিবির সন্দেহে ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হতেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গত দু-তিন দিন আগে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫ ব্যাচের এহতেশামুল আজিম নামে এক শিক্ষার্থীকে ফেসবুকের বিভিন্ন বিতর্কিত পেইজে লাইক দেওয়ার অপরাধে মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। আবরার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীরাই আজিমকে বের করে দেন বলে হলের একাধিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এ ছাড়া গত এক মাসে বিভিন্ন অভিযোগ এনে ৮-১০ জন শিক্ষার্থীকে মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ২০১১ নম্বর কক্ষে প্রায়ই মদের আড্ডা বসত বলে জানান শিক্ষার্থীরা। প্রায়ই কক্ষ থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির কথাও শোনা যেত।