কুষ্টিয়া: বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, তার পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থিত। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন এবং তাবলিগ জামায়াতের সাথে বিভিন্ন সময়ে চিল্লায়ও সময় দিয়েছেন।
কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই রোডের হানিফ নগরে স্থানীয় এমপি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের বাসার পিছনেই তাদের বাড়ি। সেই সূত্র ধরে আবরারের পরিবারের লোকজন সব সময় সেখানে বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দেয় বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে।
আজ রোববার ভোরে ফাহাদের মৃত্যুর খবর পৌঁছানোর পর কুষ্টিয়া শহরের বাড়িটিতে শোকের ছায়া নেমে আসে। খবর পেয়ে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি ও মিডিয়ার মানুষদের ভিড় শুরু হয়। সারা দিনই একই পরিবেশ বিরাজ করছিল। সবাই ফাহাদের মাকে শান্তনা দিচ্ছিলেন, কিন্তু মায়ের মন কি আর থামানো যায়? কিছুক্ষণ পর পর ছেলেকে নিয়ে বিলাপ করে কাঁদছেন আবার মাঝে মাঝে মুর্ছা যাচ্ছেন।
ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশে বাসে রওনা দেন ফাহাদের বাবা বরকতউল্লাহ।
আবরার ফাহাদের ছোট ভাই ঢাকা কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজ জানায়, ‘ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ভাইয়ার এক বন্ধু বুয়েট থেকে প্রথমে ভাইয়ের খবর দিয়ে বলেন সে মারাত্মক অসুস্থ। কিছুক্ষণ পর আবার খবর পেলাম ভাইয়া মারা গেছে। মারা যাওয়ার খবরে পুরো পরিবারের অবস্থা কি হতে পারে?’
সে আরো বলে, ‘ভাইয়ার সেমিস্টার পরীক্ষার কারণে সে বাসায় ছুটি না কাটিয়ে শনিবার সকাল সাড়ে ৯টায় কুষ্টিয়া থেকে বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। বিকেল ৫টায় সে মোবাইলে পৌঁছানোর কথা জানায়। এর পর থেকে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি আমার সাথে। ভাইয়ার মোবাইলে একাধিকবার রিং দিলেও সে ধরেনি। পরে ভাইয়ার মেসেঞ্জার অন থাকলেও সেখানে রিং হলেও ভাইয়া ধরেনি। ফলে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি।’
আবরার ফাহাদের মা রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে অত্যন্ত মেধাবী ছিল। সে স্কুল ও কলেজে সব সময় প্রথম স্থান লাভ করেছে। সে কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত নয়, সে সব সময় লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার এবং মানুষের উপকারে আবরার সব সময় ছিল আগে। তার স্বপ্ন ছিল সে বুয়েট থেকে পাশ করে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাবে।’
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার আবরারকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে আল্লাহ তাদের বিচার করবেন।’ তিনি এই হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন এবং দোষীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
আবরার ফাইয়াজ আরো বলেন, ‘আমার ভাইকে নিয়ে আমাদের পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। ভাইকে যে অপবাদে হত্যা করা হলো সেটা কখনো সঠিক নয়। ভাইয়ের মতো আমার স্বপ্ন রয়েছে, কিন্তু আমার ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে আমার স্বপ্ন শেষ।’
আবরার ফাহাদের মামা আব্দুল করিম জানান, ‘আমার ভাগ্নে কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত নয়, সে ষড়যন্ত্রের শিকার। আমাদের পরিবারের কেউ রাজনীতির সাথে জড়িত নয়, তবে আমরা সবাই আওয়ামী লীগ রাজনীতির সমর্থক। এলাকার মানুষ আমাদের চেনে এবং জানে আমরা আওয়ামী লীগ সমর্থিত মানুষ।’
তিনি জানান, ‘আবরার নামাজি ছিল। সবার সাথে তার বন্ধুত্যসুলভ আচরণ করতো সে। তুখোড় মেধাবী আবরার এলাকার মানুষের কাছে অতি আপন ছিল।’
আবরার ফাহাদের সেজ চাচা শিলাইদহ ইউনিয়ন ভূমি অফিসে কর্মরত মিজানুর রহমান জানান, ‘বংশের বড় ছেলে আবরারকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। সে অত্যন্ত মেধাবী। তাকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতাম। তার মৃত্যুতে আমরা দারুণভাবে মর্মাহত।’
তিনি জানান, ‘আবরার ফাহাদ কোনোদিনই শিবিরের রাজনীতিতে জড়িত ছিল না, সে সব সময় লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। পরীক্ষা আসন্ন, তাই ছুটি থাকা সত্ত্বেও সে শনিবার সকালে কুষ্টিয়ার বাসা থেকে বুয়েটের উদ্দেশে রওনা দেয়।’
আবরারের দাদা কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের রায়ডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি কুষ্টিয়া কালেক্টরেট অফিস থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার ছেলে-মেয়ের মধ্যে আবরার ফাহাদের বাবা বরকতউল্লাহ ব্র্যাকের অডিট বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা। তার সহকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগ সমর্থিত।
কয়া ইউনিয়ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আলিম স্বপন জানান, বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ অত্যন্ত মেধাবী, আমার জানামতে আবরারের বাবা এবং অন্য চাচারা কেউ জামায়াত-শিবিরের সাথে জড়িত নেই। তবে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ কেউ জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে।’
কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও কয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এলাকার শিক্ষিত পরিবার হিসেবে পরিচিত আবরার ফাহাদের দাদার পরিবার। তার সব চাচারাই উচ্চশিক্ষিত এবং সকলেই সরকারি চাকরজীবী। এলাকার সব মানুষের সাথেই এই পরিবারটির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এরা কোনোদিনই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না। এই পরিবারের অনেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত এবং আওয়ামী লীগের যে কোনো অনুষ্ঠানে তাদের সরব উপস্থিতি এলাকাবাসীর জানা রয়েছে।’