ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন সাধারণ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া প্রতিক্রিয়া এবং আলাপ-আলোচনায় এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। কেউবা হয়েছেন
আবার বিস্মিত। এ অভিযান শুরুর পর বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে। রাস্তায় দামি গাড়ির সংখ্যা কমে গেছে, কমেছে মোটরসাইকেলের সংখ্যাও। এতোদিন দাপটের সঙ্গে চলতেন এমন অনেক নেতা দেশত্যাগ করেছেন। অনেকে আবার চলে গেছেন আত্মগোপনে।
হত্যা, ধর্ষণের মতো অপরাধ কমে আসছে অনেকটাই।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার, অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এটা অত্যন্ত ইতিবাচক একটি বিষয়। এটা ইতিবাচকভাবে না দেখে কোনো উপায় নেই। দেরিতে হলেও প্রধানমন্ত্রী খুব একটা শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। সেটাই ওনার কাছ থেকে আমরা আশা করেছিলাম। এটা যদি চলমান থাকে এবং আরো কিছু অ্যাকশন হয় তাহলে দুর্নীতি অনেকটা কমে আসবে। কিন্তু অভিযান থেমে গেলে আবার দেখা যাবে গ্যাপের মধ্যে চলে এসেছে। এটা শুধু যে সমাজের জন্য সমস্যা তা কিন্তু নয়। ক্ষমতাসীন দলের জন্যও সমস্যা। পরিস্থিতি আউট অব কন্ট্রোল হয়ে যায়। এখন তো দেখা যাচ্ছে এরা সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে আছে। মাঝপথে যদি এটা বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সকলের জন্য এটা বিপদ হবে। সে জন্য আমি মনে করি, সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে আমরা সবাই সমর্থন করি। এটা যে অত্যন্ত পজেটিভ এবং জনপ্রিয় একটি পদক্ষেপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই অভিযানের মধ্যে দিয়ে পরিবর্তন কী করে আসবে। গোটা ব্যবস্থাটাই দুষ্টু হয়ে পরেছে। এখন কিছু অপরাধিকে চিহ্নিত করলে বা তাদেরকে জনসম্মুখে উপস্থিত করলে হবে না। গোটা ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পরেছে। ব্যবস্থাটা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এখন এই ব্যবস্থা থেকে এই রকম সংস্কারমূলক কাজ দিয়ে হবে না। একটি মৌলিক পরিবর্তন দরকার। এটা কেবল ধারাবাহিকতা রক্ষা করার ব্যাপার না। মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। অবকাঠামো ব্যবস্থায় নতুন লোকদের আনতে হবে। কি করতে হবে তা জানি না। কিন্তু এটা জানি যে, এভাবে গুটি কয়েকজনকে তুলে ধরলে হবে না। কথায় আছে, ‘আইসবার্গের উপরের অংশটা শুধু দেখা গেল। ভেতরে তো আরো অনেক কিছু ছিল’। সেখানে হাত দেয়াটা সোজা কাজ না। সেখানে হাত না দিলে কাজও হবে না, আমার মনে হয়। এতোদিন মানুষ জানতো না এটার সঙ্গে কে বা কারা জড়িত। কি হচ্ছে তাও জানতো না। একটি ক্ষেত্রে জানা গেল, জুয়া খেলা চলছিল। বিশেষ করে জুয়া খেলার বিষয়টাতো পাবলিক জানতো না। কতো টাকা আয় করেছে এবং পাচার করেছে এটাও জানতো না। এটা হচ্ছে সুবিধা জনক দিক। আরেকটি বিষয় হলো, মিডিয়া এখানে ভালো এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করেছে। মিডিয়া এগুলোকে সকলের সামনে তুলে ধরছে। পুরো বিষয়টি ব্যবসার অধীনে চলে গেছে। এখন আর নৈতিকতা, অঙ্গিকার এগুলো কার্যকর নয়। এখন ব্যবসায়ীরা সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। তারাই রাজনীতি করছে। এবং রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে। যুবলীগ বা ছাত্র লীগ নামে এই যে প্রতিষ্ঠান এদের কাজটা কি সেই প্রশ্নটাও মানুষের মনের মধ্যে এসেছে। যুবলীগ কি ক্যাসিনো ব্যবসা করে না আরো ভালো কাজ করে। ছাত্রলীগ নিজ দলের লোকদের আক্রমন করে। শো ডাউন করে। ভেতরে ভেতরে তারা আবার ঠিকাদারির সঙ্গে জড়িত। শুদ্ধি উন্মোচনটা ভালো। যে শাস্তি হবে তার চেয়ে উন্মোচনটাই আমি ভালো মনে করছি।
এ অভিযান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে। আওয়ামী লীগ নেতা শফি আহমেদ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘অপরাধীরা কোথায় গা ঢাকা দিলো! কত গভীরে, বুঝতে পারছি না! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুনীতি না হলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত। ফাঁকফোকর কোথায় এবং কারা উন্নয়ন প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তাদের খুঁজে বের করতে হবে’। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক নঈম নিজাম লিখেছেন, ‘অভিযান হালকা না করে এবার লুটতরাজের খলনায়কদের ধরুন। জি কে শামীম, খালেদ, ফিরোজদের গডফাদার কারা? জিজ্ঞাসাবাদ করে যে সব নাম পেয়েছেন ব্যবস্থা নিন। বঙ্গবন্ধু কন্যার নির্দেশ পালন করুন। সাংবাদিক অঘোর মন্ডল লিখেছেন, শুদ্ধি। সংস্কার। এই দুই দুইয়ের আপাত যোগফল অভিযান। আর সেই অভিযানের প্রতিফল, বাংলাদেশের ক্লাব সংস্কৃতির অন্যরকম এক স্বরুপ উন্মোচিত হলো। এই দেশে হাউজি, মদ, জুয়া ছাপিয়ে ক্লাবগুলো পরিণত হয়েছে ক্যাসিনোতে! বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে। ক্যাসিনো খেলতে অনেক বিত্তবান উইকেন্ডে আশপাশের বিভিন্ন দেশে উড়াল দেন। পয়সা আছে। সামর্থ্য আছে। মনে ইচ্ছা আছে। উড়াল তারা দিতেই পারেন। কিন্তু ক্যাসিনো এখন ফকিরাপুলে, এটা কী জানতেন এদেশের আমজনতা? মনে হয় না। তবে প্রশাসন, পুলিশ, ক্লাব কর্তারা জানতেন না, সেটা বলা যাচ্ছে না। তারা শুধু জানতেন, তা নয়। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে খেলাধুলার ক্লাবে গজিয়ে উঠেছে ক্যাসিনো। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়া না পেলে এ ধরনের অনৈতিক কমর্কান্ড খোদ রাজধানীতে কীভাবে চলে! অশুভ-অস্থির এক সময়ে প্রধানমন্ত্রীর শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও মানুষকে স্বস্তি জোগাচ্ছে। আশা জাগাচ্ছে। ঘর থেকে, দল থেকে যে অভিযান শুরু, সেটা চলমান থাকবে সেই প্রত্যাশাটুকু করা বাড়াবাড়ি কিছু নয়। আমরা সুস্থ সমাজের বাসিন্দা হিসেবে বাঁচতে চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য আরো সুন্দর একটা সমাজ রেখে যেতে চাই।
এদিকে, শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পর হঠাৎ করে সড়কে কমে গেছে বিলাসবহুল গাড়ির সংখ্যা। রাস্তায় কম বেশি প্রাইভেট গাড়ি থাকলেও দামি ব্রান্ডের গাড়ির সংখ্যা হঠাৎ করে কমে গেছে। ভিআইপি গাড়ির সঙ্গে কমেছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। একই সঙ্গে গাড়ির শো রুম গুলো ঘুরে দেখা যায় বিকিকিনি খুবই কম। গাড়ি বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন, একাধিক গাড়ি বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউ-এ কার হাটের বিক্রেতা মামুন বলেন, আমাদের শো রুমে সপ্তাহে আগে বাইশ থেকে পঁচিশটি গাড়ি বিক্রি হতো। সেখানে এখন বারো থেকে তেরো তে নেমে এসেছে। অনেক দিন থেকেই এই মন্দা ভাব চললেও সম্প্রতি এটা বেড়েছে। এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অনেকটা দায় হয়ে পরেছে। নিটল মোটরস গ্রুপের বিক্রেতা নিয়াজ মাহমুদ বলেন, আমাদের সব গাড়ি টাটা প্রাইভেট কার। সারে চৌদ্দ লাখ থেকে ত্রিশ লাখ টাকা মূল্যের গাড়ি রয়েছে। আমাদের শো রুমে গাড়ি বিক্রিতে প্রভাব না পরলেও খুব যে বিকিকিনি হচ্ছে এটা বলা যাবে না। কিছুটা প্রভাব পড়েছে। পাঁচ থেকে দশ ভাগ বিক্রি কমেছে। আমরা সাধারণত ব্রান্ডের গাড়ি বিক্রি করি। প্রতি মাসে পঞ্চাশটি গাড়ি বিক্রয় হয়। যেটা এখন কমে গেছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, হয়তো এই মুহুর্তে মানুষের গাড়ি ক্রয়ের প্রয়োজন নেই। যদিও আমাদের গাড়ির ক্রেতা শুদ্ধি অভিযানের ব্যক্তিদের মধ্যে পড়ে না।