ঢাকা: রাজনীতি ছিল, রাজনীতি আছে ও থাকবেও। রাজনীতিতে একাধিক দল থাকবে, এটা গনতন্ত্রের রীতি। রাজনীতিতে নেতা আসে নেতা যায়। কোন কোন নেতা যে দল থেকে শুরু করে সে দলেই থেকে যায় আমৃত। আবার কিছু কিছু নেতা আছেন, যারা একাধিক দলে গিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাধ বিভিন্ন ফ্লেভারে ভোগ করেন। দলবদল যেহেতু রাজনীতিতে নিষিদ্ধ নয়, তাই এই দলবদল নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। ত্যাগী কর্মী বনাম রাজনৈতিক কর্মী নিয়েই রাজনৈতিক দল। এই রাজনৈতিক দলগুলো দেশ সেবা করবে এটাই স্বাভাবিক। দেশপ্রেমিক এই সকল রাজনৈতিক নেতা জীবদ্দশায় যে সকল কাজ করে যায়, তা ইতিহাস হয়ে থাকে। যে নেতা যেমন কাজ করেন তেমনি হয় তার ইতিহাস।
আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কালের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়। সংস্কৃতি প্রগতিশীল বলেই পরিবর্তন হয় এটা ঠিক, তবে এই পরিবর্তন যদি মৌলিক কাঠামোর সংশোধন করে ফেলে, তবে ওই পরিবর্তনকে অপসংস্কৃতি বলা যায়। আমরা দেখেছি, কোন রাজনৈতিক দলের নেতা মারা গেলে অন্য দলের নেতারা জানাজায়ও কম যান। আবার এমনও দেখা গেছে, কোন নেতা মারা গেলে তার নিজ দলও ফুল দিতে আগ্রহ কম দেখায়। এসবই রাজনৈতিক অপসংস্কতি।
আমাদের সমকালীন রাজনীতি বিশ্লেষন করলে দেখা যাবে, যে নেতা বিরোধী দলে থাকাকালীন সময়ে রাজপথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা রক্তাক্ত হয়, ক্ষমতায় গেলে তাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। আবার কোন কোন মন্ত্রী, মন্ত্রীত্বকালীন সময়ে যে কারাগার উদ্বোধন করেন, বিরোধী দলে গেলে তাকে ওই কারাগারেও থাকতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, এমপি এমনকি মন্ত্রীত্ব থেকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক নেতার কারাগারে যাওয়ার সংস্কৃতিও চালু হয়ে গেছে। এসব গনতান্ত্রিক রাজনীতির আপডেটেড অবস্থা। মানে হল, ফুলের মালা ও হাতকড়া ক্রমশ: এসে যায় রাজনীতিবিদদের হাতে।
১৯৯০ সাল থেকে পরিবর্তিত রাজনৈতিক গনতন্ত্র কি বলে? জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বাকী সকল দল মিলে আন্দোলন করে একটি সরকার গঠন করল। ওই সরকার নির্বাচন দিল। গঠিত হল ১৯৯১ সালে গনতান্ত্রিক সরকার। তবে এই সরকার নিয়েও সমালোচনা করেছে বিরোধী দল। এরপর ওই ফর্মেটে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সব গুলোই বিরোধী দল দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
কিন্তু ২০০৭-২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক ফর্মেট ভেঙ্গে হঠাৎ চলে আসে একটি সরকার। ওই সরকারের কি নাম তা বলা মুশকিল। তবে ওই হঠাৎ সরকার এসে ক্রিয়াশীল সকল দলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। প্রধান দুই দলের প্রধান সহ ডাকসাইটের অনেক নেতাকে কারাগারে নিয়ে যায়। ধারণা ছিল, এই অবস্থার পর সারাদেশে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হবে। কিন্তু ওই সরকারের প্রখরতার কারণে কেউ রাস্তায় নামেনি। ফলে গনতন্ত্র হয়ে যায় অবরুদ্ধ। ঠিক ওই সময় কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে সর্ব প্রথম নিজ বাসায় সাংবাদিক ডেকে যিনি সরাসির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেন তিনি হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব:) আ স ম হান্নান শাহ। বিএনপির পক্ষ থেকে হান্নান শাহ ও আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নিজ দলের পক্ষে কথা বলা শুরু করেন। এর পরের ইতিহাস কারো অজানা নয়।
হান্নান শাহ সরকারের বিরদ্ধে কথা বলায় গ্রেফতার হন একাধিকবার। প্রথমেই তিনি তার বড় ছেলে সহ গ্রেফতার হলেন। বাবা-ছেলে প্রথমেই ৪ দিনের রিমান্ডে গেলেন। ওই রিমান্ড কাটে মহিলা হাজতে। তবে প্রথম গ্রেফতারের সময় হান্নান শাহ ও তার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মাছ চুরি ও চাঁদাবাজীর মত হাস্যকর মামলা। পেশাগত সাংবাদিক হিসেবে আমি তখন এই সংবাদটি করেছিলাম। তবে তখন যা পেয়েছিলাম তার সামারী হল, মাছ চুরি ও চাঁদাবাজীর মামলা দায়েরের আগেই রেকর্ড হয়েছিল। এই ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হল, বাদী নিজে ১৫ মে ২০০৭ তারিখ দিয়ে থানায় এজাহার দেন। কিন্তু থানায় মামলাটি রেকর্ড হয় ১৩ মে তারিখে। মানে হল, মামলা দায়েরের আগেই রেকর্ড। এই সংবাদ দিয়ে আমাকে অবশ্য অনেক কাঠখঁড় পোঁড়াতে হয়েছে।
যাই হউক, একটি মিথ্যা ও বে-আইনীভাবে রেকর্ডকৃত মামলায় হান্নান শাহ ছেলে সহ মহিলা হাজতেও রিমান্ডে ছিলেন। অথচ তিনিই ছিলেন ওই সময়ের ভয়ঙ্কর সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে উঠা রাজনৈতিক নেতা। পরবর্তি সময় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ওই সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে নতুন রাজনৈতিক সরকার। এরপর সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার হলেও হান্নান শাহর বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহর হয়নি। বিচ্ছিন্ন অভিযোগ রয়েছে, হান্নান শাহ যখন গুরুতর অসুস্থ হন, ওই দিনটিতেও তার মামলার তারিখ ছিল। মানে হল, মামলার তারিখ মাথায় নিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মৃত্যুর পর ইতিহাস লেখা হয়। জীবিত মানুষ তার সেবা ও ত্যাগের ইতিহাস দেখে যেতে পারেন কম। যারা অপকর্ম করেন তাদের ইতিহাস অপরাধ আকারেই লেখা হয়ে যায় তার জীবদ্দশায়ই, তবে এই সংস্কৃতিও কম। বেশীর ভাগ ইতিহাস লেখা হউক বা না হউক মৃত্যুর পরই প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ আছে। বাংলাদেশ থাকবে। রাজনীতি আসে-যায় হলেও রাজনীতিই থাকবে। কিন্তু কালের ধারায় হারিয়ে যাবে ত্যাগী নেতা ও দেশপ্রেমিকেরা। আক্ষেপ থেকে যায়, আমরা দলবাজী করতে করতে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি যে, যে কোন দলের নেতা বা কর্মীর সেবা ও ত্যাগের ইতিহাস আমরা স্বীকার করতে চাই না। কখনো কখনো ভোগের স্রোতে ডুবে ত্যাগের ইতিহাসকে কলংকিত করতেও দ্বিধাবোধ করি না। রাজনীতির বিসম অবস্থা থেকে মুক্তি না মিললে হয়ত ত্যাগী ও দেশ প্রেমিক রাজীনৈতিক নেতার জন্মই অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে আর এই অবস্থা হলে ত্যাগী নেতার জন্মই হয়ত হবে না।
হান্নান শাহর ইতিহাসে একাধিক ইভেন্ট রয়েছে। সেনাবাহিনীতে চাকুরী করা কালে যখন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান খুন হন, তখন তার লাশটি যারা কাঁধে নিয়েছিলেন হান্নান শাহ তাদের একজন। কিন্তু চাকুরী শেষে রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের দলে আমৃত থাকলেও দল তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করেছে বলে মাথা উঁচু করে কেউ বলতে পারবে না। কারণ ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর হান্নান শাহকে পাট মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব দেয়। ২০০১ সালে যখন বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসে তখন হান্নান শাহ কোন দায়িত্ব পাননি। টেকনোক্রেট মন্ত্রী বা কোন সরকারী লাভজনক পদেও হান্নান শাহকে অধিষ্ঠিত করা হয়নি। তবুও হান্নান শাহ কোন দিন দলের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেন নি। দলের প্রতিষ্ঠাতার লাশবহনকারী হান্নান শাহ কখনো দলের বিরুদ্ধে যান নি। বরং দলের ও দেশের মহাবিপদের সময় নিজেকে উৎসগ করেই ২০০৭ সালে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিায় প্রথম সিংহের মত গর্জন দিয়েছিলেন।
আজ তিনি নেই। হান্নান শাহ নেই তবে তার অর্জনের উপর শুধু কি বিএনপিই দাঁড়িয়ে আছে না দেশও! সেই কৃতজ্ঞতা জানানোর রাজনৈতিক সংস্কৃতি কবে প্রতিষ্ঠিত হবে সে আশা, আশাই থাকবে, না বাস্তব হবে, সেটা কারো জানা নেই। তাই বলা যায়, জীবিত হান্নান শাহকে ব্যবহার করেছি আমরা কিন্তু পরিচিত হতে পারিনি। তাই মৃত্যুর পরও তিনি অপরিচিতই থেকে গেলেন। হান্নান শাহ নেই, রাজনীতি আছে। রাজনীতি বহমান হউক চিরায়ত রুপে এই কামনা সকলেরই। তবে ত্যাগী নেতাদের ত্যাগ ও সেবার ইতিহাস দলমত না দেখে লেখা হউক এই দাবী থাকবেই। না হলে দেশ প্রেমিকের অভাব চিরস্থায়ী হয়ে যেতে পারে।
গতকাল তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী গেলো। হান্নান শাহর পরিবার ও তার দল নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছেন। দোয়া রইল আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন। আমিন।
লেখক
প্রধান সম্পাদক
গ্রামবাংলানিউজ