হকার থেকে বিএনপি পরে জাতীয় পার্টি হয়ে আওয়ামীলীগের হুইপ সামশুল এখন শত কোটি টাকার মালিক

Slider চট্টগ্রাম জাতীয় টপ নিউজ


চট্টগ্রাম: ১৯৮০ সালে যখন হকার ছিলেন, টাইপ মেশিন চুরির অপরাধে গ্রেপ্তার হয়ে ১৭ দিন কারাভোগ করেন। পরে হকার থেকে বিএনপির যুবদল হয়ে জাতীয় পার্টির যুব সংহতিতে যোগ দেন। রাজনীতিতে বারবার জার্সি পাল্টানো সামশুল হক চৌধুরী সর্বশেষ ‘ক্লাব’ হিসেবে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য।

চট্টগ্রাম-১২ পটিয়া আসনের আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। এই আসন থেকে টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া সামশুলের বিরুদ্ধে মানবপাচার, মাদক কারবার, ক্লাবকে জুয়ার আখড়া বানানো, বিদেশে অর্থপাচার, নালার ওপর মার্কেট নির্মাণসহ অনেক অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনী এলাকায় সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনোসহ জুয়ার আসর বসানোর সপক্ষে বক্তব্য দিয়ে আবারও আলোচনায় আসেন তিনি।

আলাদিনের চেরাগের মতো রাতারাতি আঙুল ফুলে বটগাছ বনে যাওয়া সামশুলকে নিয়ে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান নিয়ে সামশুল হক চৌধুরীর মন্তব্যে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

গত রবিবার চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে সংবাদকর্মীদের কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী। ক্যাসিনোর পক্ষ নিয়ে ওই দিন তিনি বলেছিলেন— ‘চট্টগ্রামে শতদল, ফ্রেন্ডস, আবাহনী, মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধাসহ ১২টি ক্লাব আছে। ক্লাবগুলো প্রিমিয়ার লীগে খেলে। ওদের তো ধ্বংস করা যাবে না। ওদের খেলাধুলা বন্ধ করা যাবে না। প্রশাসন কি খেলোয়াড়দের পাঁচ টাকা বেতন দেয়? ওরা কিভাবে খেলে, টাকা কোন জায়গা থেকে আসে, সরকার কি ওদের টাকা দেয়? দেয় না। এই ক্লাবগুলো তো পরিচালনা করতে হবে।’

সামশুল হক চৌধুরী সম্পর্কে দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, গত শতাব্দীর আশির দশকে সামশুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম নগরের আমতলা এলাকার হকার ছিলেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিনি হকার থেকে যুবদলে যোগ দেন। নগরের ডবলমুরিং থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরপর জাতীয় পার্টির আমলে চট্টগ্রাম পৌরসভার সুগন্ধা আবাসিকে প্লট বিক্রির নামে তাঁর বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। ওই সময় রিয়াজউদ্দিন বাজারে নালার ওপর একটি মার্কেট গড়ে তোলেন। ওই সময় তিনি যুব সংহতিতে যোগ দেন। যে সময় হকার ছিলেন তখন তিনটি টাইপ মেশিন চুরির অভিযোগে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। ১৯৮০ সালের আগস্টে সংবাদপত্রে চুরি করা টাইপ মেশিনসহ সামশুলের গ্রেপ্তারের ছবি প্রকাশিত হয়।

১৯৯৯-২০০০ সালে এক শিল্পপতির হাত ধরে চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। আবাহনী লিমিটেড কম্পানি হওয়ার পর চারদলীয় জোট সরকারের আমলে লন্ডনে ফুটবল দল নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগ ওঠে। ওই সময় সরকার ২২ জনের দল নেওয়ার অনুমতি দিলেও আরো ১৫ জন বেশি নিয়ে যান তিনি। এই অনিয়মের কারণে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন সামশুল।

২০০৭ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ লীগ অংশগ্রহণের আগে ফিফার গাইডলাইন অনুযায়ী নগরীর জিইসি মোড়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, ওই অ্যাকাউন্টে তিনজনের নাম থাকলেও তৎকালীন সভাপতি দিদারুল আলমকে বাদ দিয়েই সামশুলসহ দুজন টাকা উত্তোলন করেছেন। বিষয়টি দেড় মাস আগে জানার পর দিদারুল ওই ব্যাংকে অভিযোগ দিলে বর্তমানে অ্যাকাউন্ট স্থগিত রয়েছে।

সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে, বিদেশে অর্থপাচার, কয়েক বছরে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। প্রতিদিন আবাহনী ক্লাব থেকে পাঁচ লাখ টাকা এবং বছরে মাঠ ভাড়া দিয়ে কোটি টাকা অবৈধ আয় করেন তিনি।

হুইপের অবৈধ আয়ের বিষয়টি তাঁর বর্তমান সম্পদের পরিমাণ দেখেও অনেকটা উপলব্ধি করা যায়। সামশুল হক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংসদ সদস্য হওয়ার আগে পটিয়ায় নিজের গ্রামে টিনের একটি একচালা ঘর ছিল তাঁর। দোতলা একটি বাড়ি ছিল নগরের হালিশহরে। কিন্তু ২০০৮ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য হওয়ার পর বাড়িটি চারতলা করেন তিনি। এরপর ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার এমপি হওয়ার পর দুই কোটি টাকার বেশি খরচ করে বিলাসবহুল একটি বাড়ি করেন তিনি। নগর থেকে পটিয়ায় যাওয়ার পথে কর্ণফুলী উপজেলার ভেল্লাপাড়া এলাকায় প্রায় দুই একর জায়গাও কিনেছেন। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তাঁর একটি মাইক্রোবাস ছিল। এখন তাঁর তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া নগরীতে বহুতল একটি বাণিজ্যিক ভবনও রয়েছে সামশুল হক চৌধুরীর।

তবে অনেকেই জানায়, সামশুল হকের সম্পদের পরিমাণ এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এদের মধ্যে পুলিশ পরিদর্শক মাহমুদ সাইফুল আমিনের বক্তব্যেও হুইপের আয়ের একটা চিত্র পাওয়া যায়। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের ব্যাপারে হুইপের মন্তব্যের পরদিন ওই পুলিশ কর্মকর্তা ফেসবুক স্ট্যাটাসে দাবি করেন যে চট্টগ্রামে ক্লাবের জুয়ার আসর থেকে হুইপের আয়ের পরিমাণ ১৮০ কোটি টাকা।

নিজের নির্বাচনী এলাকার তৃণমূল নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করা এবং বিএনপি-জাতীয় পার্টির লোকজনকে আওয়ামী লীগে জায়গা দেওয়ার অভিযোগও আছে সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে। দলের একাধিক নেতা জানান, ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে রাশেদ মনোয়ার এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাছির উদ্দিন নির্বাচিত হন। কিন্তু সামশুল হকের অসহযোগিতার কারণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে তিন বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে উপজেলা কমিটির সদস্য) নাছির উদ্দিন বলেন, ‘এমপির বাধার কারণে কেবল পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতেই দেরি হয়নি, তিনি তৃণমূলের প্রায় সব কমিটিতে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির দলছুটদের জায়গা দিয়েছেন।’

এদিকে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান নিয়ে হুইপের মন্তব্যের পর চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম-সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা হুইপ সামশুলকে নিয়ে বিব্রত হতে থাকেন। তাঁদের অভিমত, আওয়ামী লীগে সামশুলের মতো অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী সামশুলকে দল থেকে বহিষ্কারেরও দাবি করেছেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতা।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের হাইব্রিড নেতাদের সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মন্তব্যের কারণে আমরা হতবাক-বিব্রত। এসব নেতাকে চিহ্নিত করার সময় এসেছে। সংসদের হুইপ আমাদের দলীয় এমপির ক্লাবে জুয়ার পক্ষে অবস্থান নেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক।’

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘উনি (সামশুল) একজন এমপি হয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত চলমান দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে তাঁর এ রকম মন্তব্য করাটা কোনো অবস্থায় সমীচীন হয়নি। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্টকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই সময়।’

চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেডের উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং নগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক দিদারুল আলম চৌধুরী দিদার বলেন, ‘রাজনীতি ও আদর্শ বিচ্যুত অনুপ্রবেশকারীদের দল থেকে বাদ দেওয়ার সময় এসেছে। সামশুল হক চৌধুরী ক্লাবে জুয়ার আসর বসিয়ে ক্রীড়াঙ্গনকে ধ্বংস করেছেন। ক্রীড়াঙ্গন থেকে এ ধরনের অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়িত করা জরুরি।’

বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সামশুল হক চৌধুরী বলেন, ‘কেউ কিছু বললেই হবে? আমি কী ছিলাম না ছিলাম, তা প্রধানমন্ত্রী জানেন। আমি অন্য কোনো দলে ছিলাম না। এগুলো নিয়ে আর কথাও বলতে চাই না। আমি সরকারের পার্ট। সরকারের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *