জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা ভাগাভাগির বিষয়ে ছড়িয়ে পড়া অডিও নিয়ে ক্যাম্পাসের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। ছাত্রলীগের একটি অংশ এখন প্রকাশ্যে টাকা পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করছে। অন্যদিকে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বিষয়টি বানোয়াট বলে বিবৃতি দিচ্ছে।
ছাত্রলীগের বাদ পড়া সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের মধ্যে মুঠোফোনে ওই কথাবার্তা হয়। রোববার এই অডিওটি ফাঁস হয় । সাদ্দামসহ তাঁর পক্ষের অনেক নেতাই এখন প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন উপাচার্য শাখা ছাত্রলীগকে এক কোটি টাকা দিয়েছে। সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন গ্রুপও সেখান থেকে ২৫ লাখ টাকা পেয়েছে।
এদিকে সোমবার সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে শাখা ছাত্রলীগের একটি পক্ষ দিনব্যাপী ক্যাম্পাসে শোডাউন দিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, শাখা ছাত্রলীগের যেসব নেতা এই কথোপকথন ও অডিও ফাঁসের সঙ্গে জড়িত তাঁদের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করতে ছাত্রলীগের অপর পক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন সংবাদে ছাত্রলীগের এই পক্ষটি ক্যাম্পাসের নিজেদের অবস্থান জানাতে এ শোডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে ফাঁস হওয়া ফোনালাপের তথ্য ‘মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও উপাচার্যপন্থী শিক্ষকেরা। একই দাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানারও।
ফোনালাপের বিষয়ে সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘উপাচার্য ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে তিনি আমাদের এই আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি (উপাচার্য) কোথা থেকে এ টাকা দিয়েছেন সেটা তিনি জানেন।’
সাদ্দাম হোসেন আরও বলেন, ‘টাকা লেনদেনের বিষয়টা যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে টেন্ডার শিডিউল বিক্রির সময় ও টেন্ডার বক্স ওপেনের সময়ের উপাচার্যের ছেলের (প্রতীক তাজদিক হোসেন) মোবাইলের কল রেকর্ড বের করলেই হয়। বিশেষ করে ৯ আগস্ট উপাচার্যের বাসায় আমাদের আলোচনার পরের এবং আগের আমার সঙ্গে উপাচার্যের ছেলের কল রেকর্ড বের করেন সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
সাদ্দাম হোসেন বলেন, গত মে মাসে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম ধাপে ছয়টি হল নির্মাণের দরপত্রের শিডিউল ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠার পর তিনিসহ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নিয়ামুল হাসান, সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে শিডিউল কেনা ও জমা দেওয়ার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নিয়ামুল হাসানও ঈদের আগে ‘ঈদ সেলামি’ হিসেবে টাকা পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
এই ফোনালাপের তথ্য ‘অসত্য, উদ্দেশ্যমূলক ও সাজানো’ বলে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সোমবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আব্দুস সালাম মিঞাঁ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উপাচার্যের সঙ্গে টাকা ভাগের কোনো আলাপ হয়নি। তিনি কাউকে অর্থ দেননি। গোলাম রাব্বানী উপাচার্যকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এই ফোনালাপের গল্প তৈরি করেছেন। এ ধরনের পরিকল্পিত মিথ্যা গল্পের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ বিবৃতি দিয়ে অডিও’এর তথ্য ‘মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে দাবি করেছে।
৬ মিনিট ১০ সেকেন্ডের ওই অডিওতে শোনা যায়, উপাচার্যের দেওয়া এক কোটি টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পেয়েছেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা। তবে জুয়েল রানা প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, এই অডিও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কেউ ছড়িয়েছে। এর তথ্যগুলো বানোয়াট।
প্রক্টরের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ নেতাকে ‘হুমকি’র অভিযোগ
ছড়িয়ে পড়া ওই অডিওর ফোন কলটি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি হামজা রহমানের মুঠোফোন থেকে করা হয়। রোববার অডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান ফোন করে তাঁকে ‘হুমকি’ দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন হামজা।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে হামজা রহমান দাবি করেন, শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অনেকেই এই টাকার ভাগ পেয়েছেন। যেহেতু ছাত্রলীগ টাকা নিয়েছে তাই দলের কেন্দ্রীয় নেতাকে বিষয়টি জানানো দায়িত্ব বলে মনে করেছেন তিনি।
হামজা রহমানের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টরের ফোনালাপটিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই অডিওতে অন্তরের উদ্দেশ্যে প্রক্টরকে বলতে শোনা যায়, ‘ফোনটা যেহেতু তোমার, তোমাকেই কিন্তু দায়টা নিতে হবে। তোমার ফোনে কথোপকথন তুমি কিন্তু দায়টা এড়াতে পার না।’ কথোপকথনের একপর্যায়ে হামজা রহমান রহমানকে বলতে শোনা যায়, ‘ক্যাম্পাসের ৪৪-৪৫ (স্নাতকোত্তর ও স্নাতক শেষ বর্ষ) ব্যাচ পর্যন্ত টাকা পাইছে স্যার, আমি এটা গোপন রাখার কী আছে স্যার?….স্যার আপনি যদি চান, আমি আপনাকে প্রমাণ দেখাতে পারব, ৪৪-৪৫ ব্যাচও টাকা পাইছে।’
এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর ফিরোজ উল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘হামজা রহমান আমার অত্যন্ত স্নেহের। সেই জায়গা থেকে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই ফোনালাপটি বানিয়ে ছড়িয়ে দিয়ে কেন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এ ছাড়া তাঁকে হুমকি ধামকি কিছু দিইনি আমি।’