সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল গঠন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গড়ার মাধ্যমে তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন।’
গতকাল শনিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে এক আলোচনাসভায় এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের আয়োজনে আলোচনাসভাটি অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তখনো দেশে ষড়যন্ত্র থেমে যায়নি। নানা চক্রান্ত চলছিল এই স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য। এটা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বা আমাদের সংগ্রামের পথে অনেক দালাল ছিল, অনেক লোকই ছিল, যারা ওই পাকিস্তানপ্রেমীই ছিল। যারা কখনো বাংলাদেশকে ভালোবাসেনি, বাংলার মানুষকে ভালোবাসেনি, বাংলার মানুষের কল্যাণ চায়নি। আর মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাদের ভূমিকা সবারই জানা। তারাই যুদ্ধাপরাধী, তারাই এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী। যাদের বিচারটাও জাতির পিতা শুরু করেছিলেন। কাজেই জাতির পিতা বেঁচে থাকলে ১০ বছরের মধ্যে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ একটি উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠত।’
বাকশাল গঠনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাতজন সংসদ সদস্যসহ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হলো। একটার পর একটা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু হলো। পাটের গুদামে আগুন, থানা লুটপাট থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত চক্রান্ত করে দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে মানুষ হত্যা করে, বঙ্গবন্ধুর পুরো কাজগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে, পুরো লক্ষ্যটাকে নস্যাত্ করে এবং স্বাধীনতার ভিশনটাকে যখন ধ্বংস করার চেষ্টা করা হলো, তখন তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেন।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আজকে অনেক সময় শোনা যায়, ‘বাকশাল’, ‘বাকশাল’ বলে গালি দেয়। এই বাকশালটা কী ছিল। এটা ছিল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। এই বাংলাদেশের অর্থনীতি হলো কৃষিপ্রধান। এই কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উত্পাদন করে। এই শ্রমিকের শ্রমের মূল্য দিয়ে এ দেশের অর্থনীতি গড়ে ওঠে। কাজেই কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গড়ার মাধ্যমে তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। সেখানে আমাদের দেশের ১৯টা জেলা ছিল। এ ১৯ জেলাকে ভাগ করে তিনি ৬০ জেলায় রূপান্তর করেন। অর্থাত্ প্রতিটি মহকুমাকে তিনি পর্যায়ক্রমে জেলায় উন্নীত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একেকটি কেন্দ্র হিসেবে সেগুলোকে গড়ে তুলে অর্থনৈতিক সুফল যেন তৃণমূল মানুষ অর্থাত্ গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছায় সেই পদক্ষেপটিই তিনি নিয়েছিলেন। গণতন্ত্র এবং ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে, তৃণমূল পর্যন্ত সেই গণতান্ত্রিক ধারাটা যাতে পৌঁছে যায়, একজন সাধারণ মানুষ তারও যেন বলার সুযোগ থাকে সেই পদ্ধতিটা তিনি বেছে নিয়েছিলেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দেশের চাষাবাদের জমি কো-অপারেটিভের মাধ্যমে চাষাবাদ করে যারা শ্রম দেবে তারা একটা অংশ পাবে, জমির মালিক তারা একটা অংশ পাবে এবং কো-অপারেটিভ বা সরকারের কাছে একটা অংশ আসবে। যেন কখনো কেউ বঞ্চিত না হয়, অন্তত যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উত্পাদন করে তারা যেন ন্যায্য মূল্য পায়, তারা যেন ভালোভাবে বাঁচতে পারে, আমাদের কৃষি পদ্ধতি যেন যান্ত্রিকীকরণ করে আধুনিকীকরণ করার কথা তিনি বলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাকে তিনি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রাইমারি শিক্ষা তিনি অবৈতনিক করে দিয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিশেষ সুযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।’
আলোচনাসভায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ত্যাগের আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করার পরামর্শ দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলাম। ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি। সেখান থেকেই আমার যাত্রা। কাজেই আমি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের এটুকুই বলব, চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে, ত্যাগের মনোভাব নিয়ে, আদর্শের সঙ্গে, ছাত্রলীগের নীতি-আদর্শ মেনে নিজেকে গড়ে তুলবে, দেশের মানুষকে কিছু দিয়ে যাবে। যেন জাতির পিতার আত্মা শান্তি পায়।’
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে এসে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই দেশকে আজকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে, জাতির পিতা নিজের সব কিছু ত্যাগ করেছেন দেশের মানুষের কল্যাণে। সেই মানুষের কল্যাণে আমরা কতটুকু কাজ করতে পারলাম, সেই হিসাবটাই আমাদের করতে হবে। আমরা কতটুকু দিতে পারলাম, সেটাই একজন রাজনৈতিক কর্মীর সবচেয়ে বড় সার্থকতা।’
আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। বক্তব্য দেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মেহেদী হাসান প্রমুখ।
আলোচনা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার বক্তব্যের আগে তাঁর হাতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু, শেখ কামাল, শেখ রাসেলের প্রতিকৃতি তুলে দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতিকৃতি উপহার দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের প্রকাশনা ‘মাতৃভূমি’র মোড়ক উন্মোচন করেন শেখ হাসিনা।