হিম আতঙ্কে রাষ্ট্রহীন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ৪০ লাখ বাংলাভাষী

Slider জাতীয় ফুলজান বিবির বাংলা


ডেস্ক: আসামে হিম আতঙ্ক ৪০ লক্ষাধিক বাংলাভাষীর মধ্যে। আজই তারা রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ছেন। কারণ, আজই প্রকাশিত হচ্ছে নাগরিকত্বের চূড়ান্ত তালিকা। এ তালিকায় ঠাঁই নেই ওইসব বাংলাভাষীর। এর বেশির ভাগই মুসলিম। এসব মানুষের পরিণতি কি হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। তবে ভারতের অভিযোগ, এসব মানুষ দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করেছে। তাদেরকে ক্ষমতাসীন বিজেপি দেশ থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে।
ফলে এত বিপুল পরিমাণ মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেখানে বসবাস করার পরও রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ায় বড় এক মানবিক সঙ্কট সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।

এ নিয়ে অনলাইন হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আসাম রাজ্যে অবৈধ অভিবাসীদের সনাক্তকরণের লক্ষ্যে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি প্রণয়ণ করা হয়েছে। এই চূড়ান্ত তালিকা আজ প্রকাশিত হওয়ার কথা। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে শুধু আসাম রাজ্যে এই তালিকা করা হয়। হিন্দুস্তান টাইমসের মতে, দশকের পর দশক বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষ অনুপ্রবেশ করেছে এই রাজ্যে। তবে এই রাজ্যে অবৈধ অভিবাসী সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে। রাজ্যের রাজিনীতিতে একটি কলহপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
রাজনৈতিক এজেন্ডা
আসামের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অধিকতর মঙ্গলের পরিবর্তে নাগরিকত্ব বা এনআইসিকে সামনে ঠেলে দেয়া বিজেপির একটি রাজনৈতিক কৌশল বলে অভিযোগ করেছে রাজ্যের ছাত্রবিষয়ক সবচেয়ে বড় সংগঠন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু)। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত অভিবাসী ইস্যুতে বড় ধরনের বিক্ষোভ গড়ে তুলেছিল এই আসু। তাতে ৮৫৫ জন মারা যান। এর ফলে স্বাক্ষরিত হয় আসাম চুক্তি। আসুর সাধারণ সম্পাদক লুরিনজ্যোতি গগৈ বলেন, আগে রাজনীতির জন্য মুসলিম ভোটারদের কংগ্রেস তুষ্ট করছে বলে অভিযোগ তুলেছে কংগেস। এখন তারা হিন্দুদের নিয়ে সেই একই কাজ করছে। এনআরসি প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকা উচিত, যা তত্ত্বাবধান করছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে একটি স্থায়ী সমাধানের পরিবর্তে বিজেপি চাইছে ফরেনার্স ইস্যুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে।
বিজেপির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ)। এআইইউডিএফ-এর সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেছেন, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হওয়ার আগে বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, বিবৃতি দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি। ত্রুটিমুক্ত একটি তালিতা প্রকাশের মাধ্যমে বিদেশী ইস্যুতে বন্ধ করার পরিবর্তে তারা এটাকে জিইয়ে রাখছে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য।
চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশের আগেই বিজেপির নেতারা ভুয়া তথ্য প্রচার করছেন বলে অভিযোগ করেছেন আসামের কংগ্রেস সভাপতি রিপুন বরা।

বিশ্বাসযোগ্যতা
চূড়ান্ত এই নাগরিকত্বের তালিকা ত্রুটিমুক্ত হবে কিনা এ বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এর মধ্যে রয়েছে আসাতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টিও (বিজেপি)। আসাম বিজেপির প্রধান রণজিত দাসও এমন প্রশ্ন তুলেছেন। ‘খাঁটি ভারতীয় নাগরিকদের’ তালিকা থেকে বাদ দিয়ে এবং ‘বিদেশী’দের তালিকায় অন্তর্ভুক্তিকরণে হতাশ বিজেপি।

ক্যাবের দিকে দৃষ্টি
ওদিকে আমাসের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল ইঙ্গিত দিয়েছেন, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর এর ‘অনিয়ম’ সংশোধনের উদ্যোগ নেবে তার সরকার। তবে কি ধরনের পদক্ষেপ হবে সেটা তিনি সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি। তবে ধারণা করা হয়, এর অর্থ হতে পারে এমন যে, কেন্দ্রীয় সরকার আবার পার্লামেন্টে ‘কন্টেনশিয়াস সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল’ (ক্যাব) পার্লামেন্টে উত্থাপন করতে পারে। এ বছরের ফ্রেব্রযয়ারিতে এই বিল পার্লামেন্টে অনুমোদন পায় নি। কারণ, বিলটি রাজ্যসভায় নিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এই বিলটির উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়া। হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, যদি এই বিলটি পাস হয় তাহলে ১৯৭১ সালের ২৪ শে মার্চের পরে যেসব বাংলাদেশী হিন্দু ভারতে গিয়েছিলেন তাদের নাগরিকত্বের একটি পথ তৈরি হবে। এর ফলে তারা এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
নিখোঁজ মানুষদের কি হবে
গত বছর জুলাইয়ে আসামে এনআরসির চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়। তা থেকে বাদ পড়ে প্রায় ৪০ লাখ বাংলাভাষীর নাম। এরপর পশ্চিমবঙ্গে আসামের এনআরসি ইস্যুটি উত্তপ্ত বিতর্কে পরিণত হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, জনগণকে বিভক্ত করতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এনআরসি করা হয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, এ ঘটনায় দেশে রক্তপাত ও গৃহযুদ্ধ হবে। তিনি আরো বলেন, এ তালিকা করার মধ্য দিয়ে ভারতীয় নাগরিকরা তার নিজের দেশেই শরণার্থীতে পরিণত হবেন। তিনি অভিযোগ করেন, আসাম থেকে বাংলাভাষীদের উৎখাত করাই হলো এনআরসির উদ্দেশ্য।
ডাটা ফাঁস
বিধানসভায় কেন্দ্রীয় একজন মন্ত্রী জেলাভিত্তিক এনআরসি তালিকার খসড়ায় কারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, কারা বাদ পড়েছেন তার একটি বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। ফলে এর মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশ আসাম সরকার অমান্য করেছে বলে অভিযোগ তোলে কংগ্রেস। এই তথ্য কিভাবে রাজ্য সরকার পেয়েছে তা নিয়ে বিধানসভায় প্রশ্ন তোলেন বিরোধী দলীয় নেতা দেবব্রত শাইক্য। এর জবাবে সুপ্রিম কোর্ট বলেন, এনআরসির রাজ্য সমন্বয়কারী প্রতীক হাজেলা যে গোপন রিপোর্ট দিয়েছেন তা আদালতের জিম্মায় থাকবে। কারণ, এতে স্পর্শকাতর তথ্য রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট হাজেলাকে নির্দেশনা দেন যে, তিনি যেন এনআরসি সংক্রান্ত কোনো তথ্য কারো সঙ্গে শেয়ার না করেন।
জেলে ঢোকানোর হুমকি
এনআরসি সমন্বয়কারী ও ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে আদালত অবমাননার অভিযোগে জেলে পাঠানোর হুমকি দেন সুপ্রিম কোর্ট। অনুমোদন ছাড়া মিডিয়ার কাছে রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলা থেকে তাদেরকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়। বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এবং বিচারপতি আরএফ নরিম্যানের বেঞ্চ থেকে বলা হয়, এনআরসি সমন্বয়কারী প্রতীক হাজেলা ও রেজিস্ট্রার জেনারেল শৈলেশ এনআরসি তালিকায় কাদের নাম আছে না নেই, অথবা আপত্তির বিস্তারিত বিষয়ে কথা বলাকে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বলে অভিহিত করা হয়। আদালত বলেন, আপনাদের দু’জনকে আদালত অবমাননার দায়ে দায়ী করা উচিত এবং জেলে পাঠানো উচিত। আপনারা যা বলছেন, তার সবটাই আমাদের ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *