খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিন। খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিষ্টের জন্ম উপলক্ষে এই উৎসব পালন করা হয় প্রতিবছরের ২৫ ডিসেম্বর। বিশ্বজুড়ে খ্রিষ্টীয় সমাজ এই দিনে মেতে ওঠে মুক্তিদাতার আগমন উল্লাসে।
কিন্তু এই উৎসব কি শুধু খ্রিষ্টানদের জন্য? অন্য ধর্মাবলম্বীদের কি এই উৎসবে কোনোই অধিকার নেই? এমন প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক! এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের যেতে হবে যিশুর জন্মের সময়ে।
আজ থেকে ২০০০ বছরের কিছু বেশি সময় আগে যিহুদিয়ার বেথলেহেম গ্রামের এক গোয়ালঘরে জন্ম হয়েছিল যিশুখ্রিষ্টের। তার জন্মের পর বেহেশত থেকে নেমে এসেছিলেন ফেরেশতারা। তারা গিয়েছিলেন মাঠে থাকা রাখালদের কাছে। ফেরেশতাদের নূরের আলোয় ভয় পেয়েছিলেন মাঠের রাখালরা। কিন্তু রাখালদের অভয় দিয়ে ফেরেশতাগণ বলে ওঠেন, ‘ভয় পেয়ো না। আজ তোমাদের কাছে আমরা এক আনন্দের সংবাদ এনেছি। এই আনন্দ পৃথিবীর সব লোকেরই জন্য।’
দেখুন ফেরেশতারা কী বলছেন? তারা বলছেন, তোমাদের কাছে একটা আনন্দের সংবাদ এনেছি। এই আনন্দ জগতের সব লোকের জন্য। এই আনন্দের সংবাদ শুধু ইহুদিদের জন্য নয়, শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, শুধু ইংরেজদের জন্য নয়, শুধু আমেরিকানদের জন্য নয়, শুধু ভারতীয়দের জন্য নয় বা শুধু বাংলাদেশিদের জন্যও নয়। এই আনন্দ সবার জন্য।
কী সেই আনন্দ সংবাদ, যা ফেরেশতারা জগতের সব মানুষের জন্য বয়ে নিয়ে এসেছিলেন? তাদের মুখ থেকেই শোনা যাক। ‘আজ দাউদের নগরে তোমাদের জন্য এক মুক্তিদাতা জন্মেছেন। তিনি যিশু প্রভু।’ হ্যাঁ, এটাই হলো সেই সুসংবাদ, যা ফেরেশতাগণ সব মানুষের জন্য বেহেশত থেকে নিয়ে এসেছিলেন। এই আনন্দ সংবাদটি ছিল একটি জন্মের সংবাদ। বিশেষ একজনের জন্ম হয়েছে এই সংবাদ।
নতুন শিশুর জন্ম নেওয়ার সংবাদ সাধারণত আনন্দের হয়। যে পরিবারে নতুন সন্তান আসে, সেই পরিবার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে জন্ম সংবাদ শোনার। ঠিক ওই সময়ে নবীদের ভাববাণী অনুযায়ী একজন মুক্তিদাতা বা নাজাতদাতার জন্মের জন্য মানুষ অপেক্ষা করছিল। আর সে জন্য ফেরেশতারা যিশুর জন্মের সংবাদ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ছুটে গিয়েছিল শিশুটিকে দেখার জন্য।
রাখালরা কীভাবে সেই কাঙ্ক্ষিত শিশুটিকে খুঁজে পেয়েছিল? ফেরেশতারা তাদেরকে একটি চিহ্ন দিয়েছিলেন। তারা রাখালদের বলেছিলেন, ‘তোমরা কাপড়ে জড়ানো ও যাবপাত্রে শোয়ানো একটি শিশুকে দেখতে পাবে, সেই শিশুটিই তিনি।’
চিহ্ন একটি বড় বিষয়। যিশুর জীবনে আমরা অনেকবার চিহ্নের ব্যবহার দেখতে পাই। রাখালদের পর পূর্বদেশ থেকে পণ্ডিতরা যিশুকে দেখার জন্য এসেছিলেন। তারাও একটি চিহ্ন দেখে যিশুর জন্মের খবর জানতে পেরেছিলেন। আর সেই চিহ্নটি ছিল একটি নতুন তারা। এই জ্ঞানী লোকেরা আকাশে এক নতুন তারা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন যে যিহুদিয়ায় এক বিশেষ রাজার জন্ম হয়েছে। তারা বহু কষ্টকর পথ পাড়ি দিয়ে সেই শিশুর খোঁজে এসেছিলেন।
যিশুর জীবনের পরবর্তী সময়ে লোকেরা তার কাছে এসে চিহ্নের খোঁজ করেছিল। তারা বলেছিল, আমাদের এমন একটি চিহ্ন দেখান, যা দেখে আমরা আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি। যিশু তাদেরকে বলেছিলেন ইউনুস নবী যেমন মাছের পেটে তিন দিন ছিলেন, তেমনি আমিও পৃথিবীর গর্ভে (অভ্যন্তরে) তিন দিন থাকব। কিন্তু ওই লোকেরা বুঝতে পারেননি যে এই চিহ্নের মাধ্যমে যিশু তার মৃত্যু, কবরস্থ এবং তিন দিন পর জীবিত হয়ে ওঠার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, অতি সাধারণ পরিবেশে এবং নিঃস্ব অবস্থায় যিশুখ্রিষ্টের এই জন্ম বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। নিঃস্ব, রিক্ত, রুগ্ণ ও হতদরিদ্র মানুষের ত্রাতা হিসেবেই যিশুর পৃথিবীতে আবির্ভাব। তিনি এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন অজ্ঞতা, কুসংস্কার, লোভ, ঘৃণা ও ভণ্ডামিতে ভরে উঠেছিল পৃথিবী। মানুষের মধ্যে ছিল না শুদ্ধতা, নীতি-নৈতিকতা।
যিশুখ্রিষ্ট কখনো কোনো নির্দিষ্ট জাতির লোকদের জন্য আসেননি। যিশু এসেছিলেন পুরো মানবজাতিকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্য। অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূর করে জগতে জ্ঞানের আলো জ্বালাবার জন্য। তার শিক্ষা, তার কাজ, তার জীবন অনুপ্রাণিত করেছে কোটি কোটি মানুষকে। সেই ২০০০ বছর আগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মানুষ তাঁর শিক্ষায় নিজেদের জীবনকে আলোকিত করেছে। এ জন্য কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ নেই। আমি অনেক সাহিত্যিক, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদকে জানি, যারা যিশুর শিক্ষাকে হৃদয়ে ধারণ করেন এবং সেই শিক্ষার আলোয় নিজেদের জীবনকে আরো আলোকিত করেন। এ জন্য কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের হতে হয় না।
যিশু শুধু খ্রিষ্টানদের যিশু নয়। তার জন্মের সময় এমনকি যিশু এই পৃথিবীতে থাকাকালীন কোনো খ্রিষ্টান ছিল না। পরবর্তী সময়ে তার অনুসারীরা খ্রিষ্টান বলে অভিহিত হন। সে জন্য, যিশুর জন্ম ও জন্মের আনন্দ এটা একতরফা খ্রিষ্টানদের জন্য নয়। সবার জন্য।
সব মানুষের জীবনে বড়দিন নিয়ে আসুক অনাবিল শান্তি ও সুখের পরশ। শুভ বড়দিন।